স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ শেষে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরছেন মানুষ। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় আসা লঞ্চে কানায় কানায় পূর্ণ। বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এই দুই ফেরিঘাটে যাত্রী ও গাড়ির উপচেপড়া ভিড়। কর্মস্থলমুখী মানুষের চরম দুর্ভোগে।
বরিশাল থেকে নাছিম উল আলম জানান, করোনা মহামারী সঙ্কটের দুবছর পরে নিকটজনের সাথে ঈদ করতে এবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে ঘরে ফিরতে পারলেও এখন কর্মস্থলমুখী জনস্রোতের চাপে বরিশাল নৌ বন্দরসহ ফেরি ঘাটগুলো বিপর্যস্তকর অবস্থায়। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানীসহ পদ্মার পূর্ব তীরের জেলা সমূহের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী ফেরি সেক্টরগুলোতে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক ২১ হাজার ২৭৬টি যানবাহন পারপারের পরেও গতকাল শনিবার সকালে সাড়ে ১ হাজার ২শরও বেশি অপেক্ষমান ছিল।
ঈদের ছুটি শেষে গত শুক্রবার থেকেই ঢাকা এবং চাঁদপুর হয়ে কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামমুখী যাত্রীদের ভিড়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দরে তিল ধরার ঠাঁই নেই। গত শুক্র ও গত শনিবার প্রায় ২০টি করে নৌযানে প্রায় দুই লাখ মানুষ বরিশাল বন্দর ত্যাগ করে। পটুয়াখালী ও ভোলা নদী বন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের আরো ৩০টি স্টেশন থেকেও আরো অর্ধশতাধিক নৌযান ঢাকা ও চাঁদপুরের লক্ষাধিক যাত্রী পরিবহনের পরে শনিবারেও একই অবস্থা অব্যাহত ছিল।
শনিবারেও বরিশাল বন্দর থেকে দুটি ক্যাটামেরনসহ প্রায় ২০টি নৌযানে আরো প্রায় ১ লাখ যাত্রী ঢাকা এবং চাঁদপুর হয়ে সন্নিহিত বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। জনস্রোতের চাপে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুনেরও বেশি যাত্রী নিয়ে নৌযানগুলো বন্দর ত্যাগ করলেও বিআইডব্লিউটিএ এবং প্রশাসনের কিছু করার ছিলনা। এমনকি গত দুদিন বিশাল বন্দরের নৌ টার্মিনালে তিল ধরার ঠাঁই ছিলনা। একটি কেবিন টিকেটের জন্য গত পনের দিন ধরে মানুষ লঞ্চের এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ধর্ণা দিলেও স্বাভাবিক সময়ের বেশি দামেও তা মিলছে না।
তবে কর্মস্থলমুখী এ জনস্রোত সামাল দিতেও রাষ্ট্রীয় নৌ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান-বিআইডব্লিউটিসি’র তেমন কোনো তৎপড়তা নেই। শুধুমাত্র ঈদের পরের ৩ দিন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থেকে বরিশাল-চাঁদপুর হয়ে ঢাকামুখী ৩ দিন ১টি করে স্টিমার সার্ভিস পরিচালনের পরে সব দায়িত্ব শেষ করেছে সংস্থাটি।
এদিকে ঈদের আগের দুদিনের মতো পড়ের দুদিনও এবার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলমুখী দেশের প্রধান ফেরি সেক্টরগুলোতে গাড়ির জন্য ঘাটে ঘাটে ফেরি অপেক্ষা করলেও গত শুক্রবার দুপুরের আগে থেকেই পদ্মার পশ্চিম তীরে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। ফলে গতকাল শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত দেশের প্রধান ফেরি সেক্টরগুলোতে এই যাবতকালের সর্বাধিক ২১ হাজার ২৭৬টি যানবাহন পারাপারের পরেও অপেক্ষমান ছিল ১ হাজার ২৬৭টি। রাজধানীর সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চরের ২১টি জেলার সংক্ষিপ্ত সড়ক পথের মাওয়া সেক্টরেও ১০টি ফেরির সাহায্যে ২৪ ঘণ্টায় ৫ সহস্রাধিক যানবাহন পারাপারের পরে অপক্ষেমান ছিল ৬০০।
অপরদিকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের সংক্ষিপ্ত সড়কপথের চাঁদপুর-শরিয়তপুর সেক্টরে ১টি কে-টাইপ ফেরি বিকল থাকার পরেও ৬টি ফেরির সাহায্যে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ১ হাজার ৩০০ যানবাহন পারাপার হয়েছে। অপেক্ষমান ছিল ২০০। উপকূলীয় ৩টি বিভাগ, চট্টগ্রামÑবরিশালÑখুলনা মহাসড়কের ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের মধ্যবর্তী ফেরি সেক্টরেও ৪টি মধ্যে ১টি ফেরি বিকল। ফলে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উপমহাদেশের সর্বাধিক দৈর্ঘের এ সেক্টরে ২৪ ঘণ্টায় ৫১৭টি যানবাহন পারাপারের পরেও ৭৭টি অপেক্ষমান ছিল। একই মহাসড়কের ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তী লাহারহাটÑভেদুরিয়া সেক্টরেও এসময়ে সোয়া ৫০০ যানবাহন পারাপার হলেও অপেক্ষমান ছিল ৯০টি।
পদ্মা সেতু চালুর পূর্বের সম্ভবত শেষ ঈদের ভিড় সামাল দিতে বিআইডব্লিউটিসি’র কারিগড়ি, বাণিজ্য ও মেরিন বিভাগের কর্মকর্তাÑকর্মচারীগণ এবার যুদ্ধকালীন তৎপড়তায় সর্বকালের রেকর্ড সংখ্যক যানবাহন পারাপারে পরিস্থিতি অনেকটাই সমাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় নৌযান মজুত থাকার পরেও যাত্রী পরিবহনে সংস্থার সীমাহীন উদাশীনতাকে ‘রহস্যজনক’ মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। বিষয়টি নিয়ে সংস্থার পরিচালকÑবাণিজ্য-এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি প্যাডেল জাহাজগুলো পুরনো এবং স্ক্রু-হুইল নতুন নৌযানে বিপুল পরিচালন ব্যয়ের কথা তুলে ধরে লোকশানের বিষয়টি জানান।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) থেকে মোজাম্মেল হক জানান, দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত দৌলতদিয়ার-পাটুরিয়া নৌরুটে জীবিকার তাগিতে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলা ও কর্মস্থলমুখী মানুষের চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দৌলতদিয়া ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা খুলনা মহাসড়কের পৌর জামতলা পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার জুড়ে গণপরিবহনের দীর্ঘ সারি। ছুটি শেষে কর্মস্থলগামী মানুষকে বয়ে আনা অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে দৌলতদিয়া ঘাট অভিমুখে মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ। বিশেষ করে এই গরমে শিশুসহ মহিলাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এদিকে গোয়ালন্দ মাল্লাপট্রি দিয়ে কয়েক হাজার প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস হামিদ মৃধার বাজার হয়ে দৌলতদিয়া হল রোডে এসে টিকিট নিয়ে বাইপাস সড়কে দীর্ঘ সারিতে আটকে আছে। দীর্ঘ যানজটের কারণ ফেরি ধীরগতি চলাচল করা ও ঘাটে ফেরি কম থাকায় যাত্রীদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অন্যান্যবারের তুলনায় মোটরসাইকেলের চলাচল উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে।
বিআইডাব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন জানান, এই ঈদে যানবাহন পারাপার নির্বিঘ্নে করতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ১৯টি ফেরি চলাচল করছে। তবে নির্বিঘ্নে যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে পারছেন বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) থেকেমো. শওকত হোসেন জানান, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে পরিবারের সাথে ঈদ শেষে কর্মজীবী মানুষ কর্মস্থলে ফিরছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে ঢাকামুখী মানুষের চাপ লক্ষ্য করা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও শরীয়তপুরের মাঝিরকান্দি ঘাট থেকে পদ্মা পারি দিয়ে রাজধানী ঢাকা ফিরতে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে মানুষের ঢল নেমেছে ৷ এদিকে শিমুলিয় থেকে দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীদের কিছুটা চাপ দেখা গেছে।
বিআইডব্লিউটিএ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ পদ্মা পার হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে ১০ ফেরিতে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। তবে রাতে ৭ ফেরি চলাচল করায় ফেরি স্বল্পতায় অনেক যানবাহনকে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এই ঘাটে শুধু হালকা যান, অ্যাম্বুলেন্স ও পচনশীল পণ্যের যান পারাপার করা হচ্ছে। অপরদিকে ১৫৫টি স্পিডবোট ও ৮৫টি লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের শিমুলিয়া ঘাটের বন্দর কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহমেদ জানান, ১০টি ফেরিতে যান পারাপার করা হচ্ছে। শিমুলিয়া ঘাটে যাত্রী এবং যানবাহনের চাপ কম। ঘাট এলাকায় অর্ধশতাধিকের মতো গাড়ি রয়েছে পারাপারের অপেক্ষায়, যার বেশিরভাগই পিকআপ। বাংলাবাজার থেকে যেসব ফেরি আসছে, প্রতিটি ফেরিতে যানবাহনের সঙ্গে যাত্রীদের বহন করতে হচ্ছে। আগামীকাল অফিস-আদালত চালু থাকায় শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় ঢাকামুখী বাড়তি যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ শিমুলিয়া বন্দর কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন জানান, লঞ্চঘাট এলাকায় যাত্রীদের বাড়তি চাপ রয়েছে। বাংলাবাজার থেকে যেসব লঞ্চ আসছে, প্রতিটি লঞ্চে যাত্রীতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আগামীকাল অফিস খোলা। তারা পদ্মা লঞ্চে পাড়ি দিয়ে বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে যে যাত্রীর চাপ পড়েছে, মনে হচ্ছে আরও বেশি যাত্রী পারাপার হবে। ১৫৫টি স্পিডবোট ও ৮৫টি লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন