স্টালিন সরকার : ‘হায়! আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী/ বল্লমের মত ঝলসে ওঠে তাঁর হাত বারবার/ অতিদ্রুত স্ফীত হয়; স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবী/ যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবী দিয়ে সব/ বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান’ (শামসুর রাহমান)। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রমজান মাসে দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের লাশ বঙ্গোপসাগরে ভেসে যায়। ওই সময় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো মওলানা ভাসানীকে ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ নামক কবিতার চিত্রপটে এভাবেই এঁকেছেন কবি শামসুর রাহমান। পৃথিবীর নিপীড়িত-নির্যাতিত গণমানুষ এবং মজলুমের এই নেতাকে ‘মসনদ’ বা ‘ক্ষমতার লালসা’ কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। নিজের ভাগ্য বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুড়ানোর রাজনীতি করেছেন। সেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গত কয়েক শতকে বিশ্বে যত বরেণ্য রাজনীতিক জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের অন্যতম মওলানা ভাসানী। অথচ তার জন্মদিন-মৃত্যুদিনে শুধু কবরে ফুল, একটি-দু’টি সেমিনার ইদানিং টিভির টকশোতে দু’একটি বক্তব্যের মধ্যেই আমরা দায় সারছি। মহত্মাগান্ধী ও নেহেরুকে ভারতে, নেলসন ম্যা-েলাকে দক্ষিণ আফ্রিকা, মাও সেতুংকে চীনের রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও মানুষ যেভাবে স্মরণ করে থাকে; আমরা কেন সেভাবে ভাসানীকে স্মরণ করছি না? সারাবিশ্বের নিপীড়িত অহবেলিত মানুষের নেতা মওলানা ভাসানী কি অবহেলিতই থেকে যাবেন? নতুন প্রজন্মের কাছে থাকবেন অপরিচিত!
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে জন্ম নেয়া আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ওই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সস্পাদক। চলমান আত্মকেন্দ্রীক রাজনীতির কানাগলির কারণে ভাসানীকে সম্মান দেখানোর প্রয়োজন না হতে পারে; কিন্তু নতুন প্রজন্মকে কি তাঁর সংগ্রামী জীবনের পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিত নয়? এ দায় কার? রাজনীতিকরা না হয় স্বার্থবাদী দলীয় গ-ির মধ্যে বন্দী; কিন্তু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নীরব কেন? আগামীতে যারা দেশ গড়বেন তাদের সামনে মওলানা ভাসানী হতে পারেন অনুসরণীয়-অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ভাসানীকে চর্চা করলে বর্তমানের সময়ের ‘ক্ষমতা লিপ্সার রাজনীতি’র বাইরের ‘জনসেবার রাজনীতি’ প্রতি নতুন প্রজন্ম উৎসাহী হবেন। দেশের রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতি সেবী, মিডিয়াগুলো কত খ্যাত-অখ্যাতদের স্মরণে মাতামাতি করে। ভাসানীকে নিয়ে কই তাদের আয়োজন? একজন গানের শিল্পী-একজন সিনেমার নায়ককে নিয়ে যেভাবে মিডিয়াগুলো মাতামাতি করে; তার সিকি ভাগ মাতামাতির দাবি কি ভাসানী রাখেন না? ভাসানীর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সবাই কি ঘুমিয়েই থাকবেন? নাকি ফুল দিয়েই দায় সাড়ানো হবে?
মওলানা ভাসানী শুধু বাংলাদেশ ও ভারত মহাদেশের নয়; তিনি আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার গণমানুষের নেতা ছিলেন। পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যম তাঁকে ‘ফায়ার ইটার’ বা অগ্নিভূক, ‘রেড মুলানা অব দ্য ইস্ট’ বা প্রাচ্যের ‘লাল মওলানা’ ইত্যাকার বিশেষণে চিত্রিত করেছেন নিজেদের মতো করে। সম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার মওলানা ভাসানীকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতার ধর্মপ্রবর্তক তকমা দেয়া হয়। কারণ কি? মার্কিনীরা ভাসানীর ওপর চটলো কেন? যিনি গণমানুষের নেতা তাঁকে নিয়ে আমেরিকার কেন এই বিয়োগার? কারণ আর কিছু নয়। ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালে ৩ ডিসেম্বর শের-এ-বাংলা এ কে. ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টি এবং মওলানা ভাসানী -হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যৌথ নের্তৃত্বের আওয়ামী লীগ নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ওই ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘নতজানু’ হওয়ার প্রতিবাদ করেন ভাসানী। অতপর মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে চীনপন্থী হিসেবে আবির্ভূত হন। আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মার্কিনপন্থী হওয়ায় ভাসানী দলের অভ্যন্তরে তীব্র প্রতিবাদ করেন। যার ফলে ভাসানী সম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষুতে পরিণত হন।
মওলানা ভাসানী আজকের আওয়ামী লীগ (নাম ছিল আওয়ামী মুসমিল লীগ) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এই দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। সারাজীবন ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ মন প্রাণ সকলি দাও’ কবিতার মতোই ‘পরের’ খেদমত করে গেছেন। পাকিস্তান সরকার সকল রাজনীতিদের মতো ভাসানীর নামেও ধানম-িতে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল। সব নেতাই প্লট নিয়ে বাড়ি করেছেন; অথচ ঘৃর্ণাভবে পাকিস্তান সরকারের দেয়া প্লট প্রত্যাখ্যান করেছেন মজলুম এই নেতা। থাকার জায়গা বেছে নিয়েছেন কুড়েঘর।
মূলত ভাসানীর ডাকে ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলন। পাকিস্তানীদের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ওই সম্মেলনে মওলানা ভাসানী প্রথম হুংকার দেন এই বলে যে, ‘পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের আসসালামু আলাইকুম জানাবে’। এই সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টায় আবির্ভূত হন। এ ছাড়াও কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করায় ১৮ মার্চ তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ওই বছরের ২৫ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠন করেন। সেখানে জড়ো হন এক ঝাঁক বামপন্থী। বাংলাদেশের রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মতিয়া চৌধুরী, আহমেদুল কবির, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুল্লাহ আল নোমান, মোহাম্মদ আফজালসহ শত শত জাঁদরেল নেতা ছিলেন তার অনুসারী। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে আমেরিকা বিরোধী শিবির বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু ইসলামী চেতনা ও ভাবধারা থেকে এক চুলও বিচ্যুত হননি। মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার কৃষক-প্রজাদের নিয়ে সামন্ত-জমিদার বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। আসামে ‘বাঙ্গাল খেদা’ নামের জনগোষ্ঠীগত হিংস্রতা রুখে দিয়ে এবং কুখ্যাত লাইন প্রথাবিরোধী সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকেই নেতৃত্ব দেন। খেলাফত আন্দোলনের পথ বেয়ে উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে উঠে আসেন ‘সামনের কাতারে’। পাকিস্তান আমলে আমাদের জাতীয় চেতনা ও সংস্কৃতিক বিকাশের তিনিই ছিলেন প্রথম তূর্যবাদক। নিজের জীবন তুচ্ছ করে রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের সেবা করার দীক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন। তাকে নিয়ে কত গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ রচিত হয়েছে; সেগুলো এখন উচ্চারিত হয় না।
শোষণমুক্ত সমাজ গঠন, সাম্য এবং নিপীড়িত মানুষের রাজনীতি করা মওলানা ভাসানীকে কেউ কেউ বলতেন কমিউনিস্ট। দেশের মার্কিনপন্থী দলগুলোর এতে সাময়িক সুবিধা হতো। ভোটের সময় গণমানুষের কান ভারী করা যেত। কিন্তু ভাসানী মহানবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-র সাম্যবাদী সাহাবি হজরত আবু জর গিফারি’র (রা.) ‘রবুবিয়ত’ দর্শনে গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন। খেলাফতে রাব্বানি তথা প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রীয় সমাজ গঠনই ছিল তাঁর সারাজীবনের ব্রত। নির্যাতিত অবহেলিত মানুষের সেবা ও নিজের জীবনাদর্শ প্রচারের জন্য গড়ে তুলেছিলেন খোদায়ী খিদমতগার সমিতি। ইসলামের সাম্যবাদী ভাবাদর্শ ও সমাজবাদী দর্শনের সংমিশ্রনে একটি শোষণহীন-সাম্য-মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল ভাসানীর আজন্মলালিত স্বপ্ন। শোষণ, পীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে করেছেন জীবনভর লড়াই। লড়াই করতে করতে আসাম থেকে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। মাটির ঘরে বসবাস, সাধারণ মানুষের পোশাক, মাটির শানকিতে খাবার খাওয়া ভাসানী ছিলেন কার্যত দুর্বিনীত শাসকদের ত্রাস। তার হুংকারে ‘ক্ষমতার মসদন’ কেঁপে উঠতো। ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে রাস্তায় সমাবেশ করতে দেবে না! ঠিক আছে সমাবেশ করবেন না। তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেন নামাজে। তার পিছনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে যেত। নামাজ শেষে মোনাজাত ধরতেন এবং সে মোনাজাতে সমাবেশের ‘সব বক্তব্য’ তুলে ধরে সরকারকে নাস্তানাবুদ করতেন। কেউ তার মুখ বন্ধ করতে সমাবেশের জন্য ২ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে শান্তির ঢেঁকস তুলছেন! সমাবেশে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন দুই লাখ টাকা দিয়ে আমার মাথা কিনতে চাও? এই হলো মওলানা ভাসান। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকেও হার মানাতো তার ডাক। ডাক দিলেই লাখ লাখ মানুষ কাজ ফেলে পঙ্গপালের মতো পথে নেমে আসতেন। মজলুম জননেতার ‘খামোশ’ আওয়াজে কেঁপে উঠেছে জালিমের সিংহাসন। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে তাঁর লংমার্চ আজো ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে যে ৮ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় তার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা, দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ দাযিত্ব পালন করেন। ওই সময় ভারতে অবস্থানকালে তিনি দুইবার অসুস্থ হন। তিনি ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক হককথা প্রকাশ করেন। ’৭৪ সালে করা মুজিব-ইন্দিরা মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫ থেকে ২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। যার জনসেবা ও কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি লিখলে উপন্যাস-মহাউপন্যাস হয়ে যাবে। যে নেতা এখনো প্রাসঙ্গিক। সেই ক্ষণজন্ম নেতা কি অবহেলিতই থেকে যাবেন? ক্ষমা করো হুজুর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন