শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর

কৃষি অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেত! দুষণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে মাছের জীবনচক্র বর্ষা মৌসুমে ভারি বৃষ্টিতে সিলেটের মতো অনেক শহর পানিতে ডুবে যাবে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০২২, ১২:০০ এএম

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সারা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো নদ-নদী। সামান্য বৃষ্টি হলেই দেশের সেই নদ-নদীগুলো উছলে পানি আশপাশের বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার ভাসিয়ে দিচ্ছে। সিলেট শহরে বন্যর দৃশ্য অনেককে হতবাক করেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, স্থানীয় সুরমা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। শুধু সিলেট নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বেশির ভাগ নদীর একই অবস্থা। এমনিতেই দেশের প্রায় সব নদ-নদীতে পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব। তারপর সিটি করর্পোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকা দিয়ে বয়ে চলা নদীতে পলিথিন সবচেয়ে বেশি পলিথিনের স্তর বেশি দেখা যায়।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। দেশে ব্যবহৃত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের স্ট্র, কটনবাড, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, প্লাস্টিক, ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্লাস্টিক কৃষি জমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে এসব প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করছে। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, পলিথিনসহ হিসাব করলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়।

নিষিদ্ধ পলিথিন প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। এতে নদী ও নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। অথচ পলিথিন উৎপাদন নিষিদ্ধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ এ পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা’। ‘বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে’। আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও এর উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার থেমে নেই। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে।

সিলেট শহরে বন্যার পানি উঠা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, প্লাস্টিকে তলদেশ ভরাট হয়ে সুরমার পানি উপচে সিলেট নগরে ঢুকেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবল বর্ষণে আন্তঃসীমান্ত সব নদী দিয়ে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢল নামছে। এই ঢলের সঙ্গে আসছে হাজার হাজার টন মাটি ও বালু। এ কারণে আকস্মিক বন্যার মুখোমুখি সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষ। সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ২৬টি ছোট-বড় পাহাড়ি ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) ও খাল দিয়ে দৈনিক অর্ধশত টন পলিথিন ও প্লাস্টিকযুক্ত বর্জ্য সুরমা নদীতে গিয়ে মেশে। এতে সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সুরমা নদীর পানি উপচে ঢলের পানি নগরে ঢুকেছে। সিলেট নগর ছাড়াও সিলেটের ১৩টি উপজেলা এবং সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর একটাই কারণ, গত কয়েক দশকে সিলেটের বড় দুই নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে নদীতে বড় বড় চর জাগে। অসংখ্য নদী মরে গেছে।

শুধু সিলেট নয় সারা দেশের নদ-নদীর একই চিত্র। প্রায় প্রতিটি নদীর তলদেশ প্লাটিকের স্তরে ভরে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদী; বরিশালের কীর্তনখোলা নদী; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এছাড়া নরসুন্দা, নবগঙ্গা, সুরমা, করতোয়া, ইছামতিসহ বিভিন্ন নদ-নদী পলিথিন দূষণ রয়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর জমার কারণে নদীর দূষণ ছাড়াও জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে! পরিবেশবিদরা বলছেন, নদীর তলদেশ থেকে প্লাস্টিক ও পালিথিন মুক্ত করা না যায় তাহলে সিলেটের মতো রাজধানী ঢাকাসহ অনেক শহরে বন্যার সময় পানি উঠবে।

রাজধানী বুড়িগঙ্গার কয়েকটি পয়েন্টে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, নদীর মাঝে ও দুই পাড়ে ময়লার ভাগাড়। যেসব ময়লার মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল ও পলিথিনের ব্যাগ। আশপাশের বাসিন্দা ও দোকানিদের সমস্ত ময়লা প্রতিদিন নিয়ম করে এই নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য দিয়ে নদীকে এমনভাবে ভরে আছে যে কোনো দিকে আর পানি চলাচলের অবস্থা নেই।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নদ-নদীর তলদেশ ভরাট করা প্লাস্টিকের ২২ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এবং ৭৮ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে শহরে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে ফুড প্যাকেজিং খাতে। বছরে প্রায় ৫৪ হাজার প্যাকেট বর্জ্য হিসাবে আসছে। এরপরই রয়েছে কটনবাড, শ্যাম্পু, পেস্টের টিউব এবং স্ট্র। এসব পণ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, এয়ারলাইন্স, সুপারশপ ও কমোডিটি পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।

পলিথিন বন্ধে কঠোর আইন রয়েছে কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ নেই। পরিবেশবিদরা জানান, ২০০২ সালে পলিথিন বন্ধে আইন পাস করার পর পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পরবর্তীতে সেই কঠোরতা আর থাকেনি।

দেশের আশিভাগ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজ, মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনীতির সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সারা দেশে নদীর পানিতে হাজার হাজার একর জমিতে ধানসহ নিভিন্ন ধরণের ফসল ফলানো হয়। তলদেশে প্লাস্টিক ও পালিথিনের স্তর জমে যাওয়ায় নদ-নদী পানি ধরে রাখতে পারছে না। এতে সামান্য বৃষ্টিতে পানি উঠলে পড়লেও অন্য সময় শুকিয়ে যায়। ফলে কৃষক জমিতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পান না। দেশের এই নদ-নদী যদি পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ অব্যাহত থাকলে তাহলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন