দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও আগামী নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করাকেই নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করেন আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম।
গত সোমবার সকালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ডে তার নিজ কার্যালয়ে ইনকিলাবের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি নিজের এ চ্যালেঞ্জের কথা জানান। এ সময় তার উপর বিশ্বাস রাখার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন শামীম।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহি কমিটির সদস্য থেকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়াকে দীর্ঘদিনের কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন বলে মনে করেন শামীম। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ ৫ বছর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলাম। ছিলাম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভিপি। ছাত্রলীগের দায়িত্বকালীন সময়ে সারাদেশ ঘুরেছি। ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেছি। দেশের প্রতিটি এলাকায় কমবেশি অনেক নেতাই (বিশেষ করে যারা ছাত্রলীগ থেকে উঠে এসেছেন) আমার সুপরিচিত। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে থেকেও ৫ বছর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সবমিলে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আমার কাজের মূল্যায়ন এবং দলীয় সভানেত্রীর আগামীর লক্ষ্য বাস্তবায়নের নির্দেশ বলেই মনে করি। তিনি বলেন, আমার উপর নেত্রীর দেয়া এই দায়িত্ব বিশ্বাস, বস্তুনিষ্ঠ এবং একাগ্রচিত্তে পালন করবো। এই দায়িত্বকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।
এনামুল হক শামীম বলেন, আওয়ামী লীগ এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও শক্তিশালী জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ২০তম জাতীয় সম্মেলনে এই সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে আমি আনন্দিত ও নিজেকে ধন্য গর্বিত মনে করছি। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ, তিনি আমার হাতে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই সম্মেলনের সকল কাউন্সিলরদের প্রতি।
শামীম বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আমি নতুন, কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমি ২০০২ সাল থেকেই দায়িত্ব পালন করছি। একবার অবজারভার মেম্বার। দুইবার কেন্দ্রীয় সদস্য। এবার ৪র্থবারে এসে আমি সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমার রাজনৈতিক বয়স ৩৫ বছরেরও অধিক। স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দিয়ে ’৮০ সালে আমি রাজনীতি শুরু করেছিলাম। তারপরও আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল দল, যে দল এই মুহূর্তে শুধু বাংলাদেশে সর্ববৃহৎই নয়; সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশেই শুধু নন, সারাবিশ্বে যার নেতৃত্ব প্রশংসিত; সেই দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়া নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। আমি আশাকরি, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে সারাদেশে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে পারবো। জননেত্রী যে বিশ্বাস নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে একাগ্রচিত্তে বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে, জননেত্রীর প্রশ্নে, আদর্শের প্রশ্নে কোনো আপোষ করবো না।
তিনি বলেন, আপনি জানেন, আমাকে সবচেয়ে বড় সাংগঠনিক বিভাগ চট্টগ্রামের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে ১৫টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। চট্টগ্রামের দায়িত্ব পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। চট্টগ্রাম হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বিভাগ। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৬৬ আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলন সংগ্রামে চট্টগ্রামের ভূমিকা আছে। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএ হান্নানসহ বঙ্গবন্ধুর সাহচার্য পাওয়া অনেক নেতাকর্মী এখানে রয়েছেন।
রাজনীতির সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়ে শামীম বলেন, নেতাকর্মীদের সহযোগিতা নিয়ে, পরামর্শ নিয়ে প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে, প্রতিটি গ্রামে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবো। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কারণে আমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই, এই দলকে পরাজিত করতে পারে। কারণ, দেশের মানুষ এখন কথায় কথায় বাস পোড়ানো চায় না, মানুষ হত্যা চায় না। তারা শান্তি চায়। তারা উন্নয়ন চায়। আর উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। ইতোমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ দেখেছে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়াই পদ্মা সেতু হচ্ছে। হাতিরঝিল তৈরি হয়েছে। ঢাকা শহরের ফ্লাইওভার হচ্ছে। সারাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারবে না। মানুষ নৌকাতেই ভোট দেবে। শুধু এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগের জটিল রাজনৈতিক এলাকা চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। যেখানে রয়েছে দলটির প্রভাবশালী ও প্রবীণ অনেক নেতা। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন। এ জটিল এলাকায় দায়িত্বকে সমস্যা হিসেবে দেখছেন না শামীম। তিনি বলেন, আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি তারা সবাই অকাট্যভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে চলি। তিনি যে নির্দেশনা দেন তা বাস্তবায়নে কাজ করি। আমি মনে করি আমাকে জননেত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালনে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের নেতাকর্মীরা উৎসাহ-সহকারেই আমার পাশে থাকবেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে আমাকে সহযোগিতা করবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পল্টন ময়দানে জনসভায় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমার হাতে বই-খাতা তুলে দিয়েছিলেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এবারের দেয়া দায়িত্বও আমি পালন করতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি।
চট্টগ্রাম বিভাগ প্রসঙ্গে শামীম বলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি বৃহৎ বিভাগ। এখানে অনেক প্রবীণ নেতা রয়েছেন। তিনি বলেন, প্রবীণ-নবীনদের সঙ্গে কাজ করার আমার অভিজ্ঞতা আছে। প্রবীণদের দলের অলংকার উল্লেখ করে শামীম বলেন, সারাদেশের মত চট্টগ্রামেও নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে। প্রবীণরা আমাদের প্রাণ। তাদের দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় পরামর্শ এবং তাদের নানা দিকনির্দেশনা আমার চলার পথে উৎসাহ যোগাবে। আমার চেষ্টা থাকবে চট্টগ্রাম বিভাগকে একটি সুশৃঙ্খল এবং আওয়ামী লীগের জন্য একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক বিভাগে রূপান্তরিত করার।
বিএনপি’র রাজনীতি এখন দেউলিয়াপনায় চলে গেছে মন্তব্য করে এনামুল হক শামীম বলেন, দেশের মানুষ আর জ্বালাও-পোড়াও চায় না। তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চায়। দেশের উন্নয়ন চায়, সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চায়, যার সবই করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে নিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দও এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। সমৃদ্ধশালী উন্নত বাংলাদেশ গড়তে এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই, শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।
নাসিরনগরে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা বিএনপি-জামায়াতের কাজ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। এধরনের যত ষড়যন্ত্রই হোক লাভ হবে না। জনগণ জানে ক্ষমতার লোভে এদেশে কারা জ্বালাও-পোড়াও করে, মানুষ হত্যা করে, হেফাজতের আন্দোলন সৃষ্টি করে। মানুষ এও জানে, এই চক্রটিই নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে ফায়দা লুটতে চাচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আগাম নির্বাচন প্রসঙ্গে শামীম বলেন, খালেদা জিয়া আন্দোলনেও ব্যর্থ, নির্বাচনেও ব্যর্থ। তিনি তো এখন জনগণের নেত্রী না। নির্বাচন নির্বাচন করছেন কিন্তু আগামী নির্বাচনে ব্যালটে তিনি জনরোষের বহিঃপ্রকাশ পাবেন। জনগণ উন্নয়ন ও শান্তির জন্য নৌকাকেই বেছে নেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে শামীম ইনকিলাবকে বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে আমাদের দলের বক্তব্য সুস্পষ্ট। আমাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাজ্জাক সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার নিজের ব্যক্তিগত বক্তব্য। আপনি জানেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। তার নীতি হচ্ছে যার যার ধর্ম সে সে স্বাধীনভাবে পালন করবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো চিন্তা-চেতনা আওয়ামী লীগের নেই। আমাদের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমি পুনর্ব্যক্ত করতে চাই।
একেএম এনামুল হক শামীম শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার পাইকবাড়িতে ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ (জাকসু) ভিপি নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অবজারভার মেম্বার নির্বাচিত হন। এরপর ২০১২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পরপর ২বার সদস্য থাকার পর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শামীম। গত সপ্তাহের বুধবার তাকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন