যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প ইসলাম বিদ্বেষী লে. জেনারেল মাইকেল টি. ফ্লিনকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। ট্রাম্পের অন্তর্বর্তী টিমের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সামরিক পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ভূমিকা পালনকারীর পদে ট্রাম্প এই সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বসাতে চলেছেন যিনি ইসলামপন্থী জঙ্গিদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী বলে মনে করেন।
একজন নিবন্ধীকৃত ডেমোক্র্যাট জেনারেল ফ্লিন (৫৭) ট্রাম্পের নির্বাচন প্রচারণাকালে তার প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি যদি ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণ করেন, যা ধারণা করা হচ্ছে, তাহলে তিনি হবেন এমন একজন প্রেসিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ গেটকিপার যার সামরিক বা পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সামান্য।
ট্রাম্প এবং জেনারেল ফ্লিন দু’জনেই নিজেদের বেপরোয়া বহিরাগত বলে মনে করেন যারা একটি বড় সময়ে নিজেদের পথ তৈরি করে নিয়েছেন। তারা প্রায়ই তাদের নিজেদের সাফল্যের গাথা টুইটারে পোস্ট করেন এবং তারা উভয়েই একই সময়ে পুরোপুরি ইসলামভীতিগ্রস্তদের সারিতে নিজেদের যুক্ত করেছেন।
তারা দু’জনেই কিছু ঘটনার সাথে নিজেদের শিথিল সম্পর্ক প্রদর্শন করেছেন। যেমন জেনারেল ফ্লিন বলেছেন যে শারিয়া বা ইসলামী আইন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ছে (আসলে তা নয়)। তার সন্দেহজনক কথাবার্তা এত প্রচলিত যে তিনি যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চালাতেন সে সময় অধীনস্তরা এ স্বভাবের জন্য তার একটি নাম পর্যন্ত দিয়েছিল, তারা তাকে ডাকত ‘ফ্লিন ফ্যাক্টস’ নামে।
একজন উপদেষ্টা হিসেবে ট্রাম্পের উপর ফ্লিনের বিরাট প্রভাব থাকার ব্যাপারটি প্রমাণিত। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিতকে বুঝিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী জঙ্গিদের সাথে বিশ^যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনসহ আগ্রহী যে কোনো মিত্রের সাথে মিলে এ লড়াই চালাতে হবে।
জেনারেল ফ্লিনকে সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও রাজি হননি। নির্বাচনের আগে অসংখ্য বক্তৃতা ও সাক্ষাতকারে এবং আগস্টে প্রকাশিত একটি বইয়ে তিনি বিশে^র একটি চিত্র তুলে ধরেন যাতে দেখা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র একক, ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন যাকে একমাত্র এভাবেই বলা যেতে পারে ‘উগ্র ইসলামী সন্ত্রাস।’
ফ্লিনের জন্য এসবই অপ্রধান বিষয়। হুমকির অন্য যে কোনো ধরনের বর্ণনা হচ্ছে বাজে ধরনের রাজনৈতিক শুদ্ধতা, নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন।
জেনারেল ফ্লিন বলেন, ইসলামী জঙ্গিবাদ বৈশি^ক পর্যায়ে অস্তিত্বশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে উঠছে এবং ইসলাম নিজেই সমস্যার উৎস। তিনি ইসলামকে ধর্ম নয়, একটি রাজনৈতিক মতবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। কোনো কোনো সময় তিনি এমনকি একে ক্যানসারও বলেছেন।
জেনারেল ফ্লিনের জন্য ট্রাম্পের নির্বাচন জীবনের বিস্ময়কর মোড় ঘোরানো ঘটনা। তার প্রজন্মের অত্যন্ত মর্যাদাবান সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত জেনারেল ফ্লিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে মাত্র দু’বছর চাকরি করার পর বরখাস্ত হন। তারপর তিনি এক ওয়াশিংটন এলিটের সোচ্চার সমালোচক হিসেবে পুনরাবির্ভূত হন যিনি যথাযথভাবে প্রকৃতশত্রু উগ্র ইসলামকে চিহ্নিত করতে পারেননি বলে তার সাথে বাক-বিত-ায় লিপ্ত হন।
অন্তর্বর্তী সময়ে ট্রাম্পকে যখন প্রাত্যহিক গোয়েন্দা ব্রিফিং করা হয় জেনারেল ফ্লিন তখন উপস্থিত থাকেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগর বিষয়ে চীনের সাথে শক্তি প্রদর্শন বা এবোলা মহামারির মত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংকটের মত সংকটকালে প্রেসিডেন্ট কিভাবে সাড়া দেবেন সে বিষয়ে তিনিই শেষ কথা বলবেন।
ট্রাম্পের মত তিনিও গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়েই হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের পদ থেকে ওবামা তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। তারপর তিনি ফ্লিন ইন্টেল গ্রুপ নামে একটি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে তার ধোঁয়াশে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে এবং তার প্রতিষ্ঠান তুর্কি সরকারের পক্ষে লবি করে বলে অনুমান করা হয়। জেনারেল ফ্লিন গত বছর ক্রেমলিনের অর্থে পরিচালিত টেলিভিশন নেটওয়ার্ক রাশিয়া টুডে’র সাথে অর্থের বিনিময়ে বক্তৃতা প্রদানের কাজ করেন এবং মস্কোতে নেটওয়ার্কের ব্যয়বহুল বার্ষিক উৎসবে যোগ দেন। সেখানে তিনি পুতিনের কনুইয়ের কাছে বসেছিলেন।
সম্ভাব্য স্বার্থবিরোধ ট্রাম্পের অন্তর্বর্তী টিমকে উদ্বেগে ফেলতে পারে যে এ রকম একটি পদে নিয়োগ লাভে জেনারেল ফ্লিন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন যাতে কিনা কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। যেমন সিআইএ পরিচালক। তবে এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের জন্য একটি বিরাট যুক্তি আছে। ফ্লিন ছিলেন নির্বাচনী প্রচারণার একজন প্রথম দিকের ও দৃঢ় সমর্থক যখন ওয়াশিংটনের জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই নেতৃত্বের জন্য ট্রাম্পকে খোলাখুলি অযোগ্য ঘোষণা করেছিল।
ট্রাম্পের মধ্যে ফ্লিন এমন একজনকে পেয়েছেন যিনি শুনতে খুব বেশী আগ্রহী। তিনি উপস্থিতভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার চুক্তিবদ্ধ হন এবং দ্রুত জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের এক রাগী কন্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তিনি সমাবেশ ও রিপাবলিকান সম্মেলনগুলোতে হিলারির বিরুদ্ধে “তাকে তালাবন্ধ কর” সেøাগান প্রদানে নেতৃত্ব দেন। দু’ব্যক্তি মাসের পর মাস একে অপরের সাথে কথা বলার পর এখন বলা কঠিন হতে পারে যে কোথায় ট্রাম্পের দৃষ্টির শেষ আর কোথায় ফ্লিনের শুরু।
উভয়েই মনে করেন যে ইসলামী জঙ্গিদের পরাস্ত করতে এবং দেশে পুতিনের সমালোচকদের দমন, ইউক্রেনকে অঙ্গহীন করার চেষ্টা অথবা সিরিয়ার শহরগুলোতে রুশ সামরিকবাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের তার সাথে কাজ শুরু করা দরকার। একই কথা মিসরের আবদেল ফাত্তাহ সিসির জন্যও প্রযোজ্য যিনি নির্বাচনের পর বিশ^ নেতাদের মধ্যে প্রথম সিসির সাথে কথা বলেন।
ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের জনগণ ও নেতাদের দিকে দেখছেন আর বলছেন, আমি কি এর সাথে কাজ করতে পারব? আমাদের কি অভিন্ন হুমকি আছে যার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে? নির্বাচনের আগে এক সাক্ষাতকারে ফ্লিন বলেন, তিনি জানেন যে এটা যখন রাশিয়া অথবা যে কোনো দেশের প্রসঙ্গ হয় তখন আমাদের সবার অভিন্ন শত্রু উগ্রপন্থী ইসলাম।
জেনারেল ফ্লিন ও ট্রাম্প একমত যে মুসলিম প্রধান দেশগুলো থেকে অভিবাসী আগমন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপকভাবে হ্রাস করা উচিত এবং সম্ভব হলে সুসলমানদের সরকারের কাছে নাম নিবন্ধনে বাধ্য করা প্রয়োজন।
এ বিষয়গুেেলা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে। জেনারেল ফ্লিন ওয়েস্ট পয়েন্ট কুলুজি ছাড়াই সামরিক বাহিনীতে আসেন। তিনি রোড আইল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ে আর্মি রিজার্ভ অফিসার্স ট্রেনিং প্রোগ্রামে স্নাতক হন এবং এবং স্পষ্টভাষী ও ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে খ্যাত হন। তিনি সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীর শীর্ষপদে ওঠেন।
জেনারেল ফ্লিন এখনো একজন বহিরাগতের অবজ্ঞা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি মনে করেন তিনি তার প্রাপ্যমর্যাদা পাননি। উদাহরণ স¦রূপ; তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তার চাকরিচ্যুতির জন্য একজোড়া সুসজ্জিত অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিকে দায়ী করেন। তারা হলেন জাতীয় গোয়েন্দার পরিচালক জেমস আর, ক্ল্যাপার ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার আন্ডারসেক্রেটারি মাইকেল ভিকার্স।
তার নতুন বসের মত তার জবাবও হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে একটু সমঝে দেয়া। তার দৃষ্টিতে দুই প্রেসিডেন্সির মাধ্যমে আমেরিকার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির রূপদানকারী ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রভাবশালীরা ভুল কারণসমূহের জন্য আমাদের বিশৃঙ্খলার পর বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলেছে।
যে সব কট্টরপন্থী রিপাবলিকান এখন দলে প্রাধান্য বিস্তার করেছেন, তাদের মধ্যে জেনারেল ফ্লিন এক বরেণ্য নেতায় পরিণত হয়েছেন, আর তা হয়েছে ওবামা প্রশাসনের বিশ^াসঘাতকতার বিরুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকার কারণে। তিনি জোর দিয়ে বলছেন যে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানপদ থেকে তাকে বরখাস্তের কারণ হচ্ছে ইসলামী জঙ্গিরা পশ্চাদপসরণ করছে বলে প্রশাসনের মত মেনে নিতে তিনি অস্বীকার করেন। (যে কোনো বিচারে তিনি ঠিক ছিলেন)
হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান ও ফ্লিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ক্যালিফোর্নিয়ার রিপাবলিকান প্রতিনিধি ডেভিন নুনেস বলেন, তিনি একজন বিশ্লেষক যিনি বিভিন্ন বিষয়ের গভীরে যেতে পারেন এবং ত্রিমাত্রিক দাবা খেলা ভালো খেলেন। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বলেন আল কায়েদার ব্যাপারে প্রশাসন ভুল করেছে।
তবে ফ্লিনের সাথে যারা কাজ করেছেন তাদের অনেকেই তার বরখাস্তের কারণ হিসেবে ব্যবস্থাপনা সমস্যার কথা বলেন। তারা বলেন, বিস্তৃত সংস্থার সংস্কারের জন্য তার চেষ্টা এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তারা এ প্রশ্নও করেন যে যদিও তিনি আফগানিস্তান ও ইরাকে জঙ্গি নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করায় বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দেন, তার কৌশলগত সূক্ষ্মদৃষ্টি হোয়াইট হাউসের যা প্রয়োজনীয় সেই কৌশলগত চিন্তায় কোনো কাজে লেগেছিল কিনা।
২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সামরিক গোয়েন্দার পরিচালক থাকাকালে জেনারেল ফ্লিনের সাথে কাজ করেছেন ওয়াশিংটনে কার্নেগি এনডাউমেন্টের সারাহ চায়েস। তিনি বলেন, তিনি একজন মেধাবী তথ্য সংগ্রহকারী।
তিনি বলেন, তবে তার চিন্তা প্রক্রিয়া যথেষ্ট রূপে বিশ্লেষণ মূলক নয়। যদি আপনি তার কথা শোনেন, দশ মিনিটের মধ্যেই শুনতে পাবেন যে দু’ থেকে তিনবার তিনি স্ববিরোধী কথা বলছেন।
ইসলাম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করুন। নির্বাচনের পূর্বে সাক্ষাতকারে তিনি ইসলামকে অসহিষ্ণু বলে আখ্যায়িত করেন। তারপর তিনি বলেন যে তার অনেক মুসলিম বন্ধু রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলামী সংস্কৃতি বোঝার কাজটি করা ও ইসলামের সহনশীলতার দিকটি লালন করা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন