“হাত পেতে ভিক্ষা চাইবে না কেউ। কাউকে ভিক্ষা করতে দেখলেই পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে আটকে রাখবেন সমাজসেবা অধিদফতরের আশ্রয় কেন্দ্রে। পর্যায়ক্রমে রাজধানীতে অবস্থানরত সকল ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হবে।”Ñ ২০১০ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে এ ঘোষণা দেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে শুরু হয় জরিপ। এই জরিপের কাজ পাওয়ার জন্য আবেদন করে ৪০টির বেশি এনজিও। এ কাজে বরাদ্দ ছিল ১৭ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর সাতটি এলাকাকে সাড়ম্বরে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে টানানো হয় সাইনবোর্ড। শেষ পর্যন্ত ওই সাইনবোর্ড টানানোতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে রাজধানীর ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম। রাজধানীর কোথাও বন্ধ হয়নি ভিক্ষুকদের বিচরণ। ২০১০ সালে প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে অবস্থানরত বিভিন্ন জেলার ২ হাজার ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩২১ জনকে এ সুবিধার আওতায় আনতে পেরেছে সরকার। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চালু হওয়া ভিক্ষুক পুনর্বাসন পাইলট প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি। এ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি জায়গা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ভিক্ষুকরা পুনর্বাসনের টাকা নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরছে বলে গত বুধবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
সংসদীয় কমিটিতে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পর্যন্ত ময়মনসিংহে ৩৭, জামালপুরে দুই দফায় ৪৪, গোপালগঞ্জে ৯২, সুনামগঞ্জে ৫০ এবং নড়াইলে ৯৪ জনসহ মোট ৩২১ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ময়মনসিংহের ৩৭ ভিক্ষুকের মধ্যে ১২ জনকে রিকশা, ১৭ জনকে ভ্যান এবং পুঁজি হিসেবে ক্ষদ্র ব্যবসার জন্য বাকিদের ৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১০ জন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। বাকিদের কেউ কেউ উপকরণ বিক্রি করে ঢাকায় ফিরে এসেছে। এখন আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে অন্যান্য জেলার অবস্থা স্বাভাবিক দেখানো হলেও সংসদীয় কমিটির সদস্যরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর সব ভিক্ষুককে নিজ নিজ এলাকায় পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও গত ৬ বছরে মাত্র ৩২১ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকা, হোটেল সোনারগাঁও ও রূপসী বাংলা এলাকায় বেশ কয়েকজনকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। ছবি তুলতে গেলেই দৌড়ে পালায় তারা। শুক্রবার নামাজ শেষে হাইকোর্ট মসজিদের সামনে মরিয়ম বলেন, কোনো সাহায্যের কথা শুনিনি। ক্ষুধার জন্যই ঢাকায় আছি। তবে এখানে ভিক্ষা করার সময় পুলিশ অনেক মারধর করে। তারপরেও পেটের দায়ে ভিক্ষা করি।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, কাজে গতি আনার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত এনজিওদের কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংসদীয় কমিটির এক সদস্য জানান, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের টাকা অন্য খাতে চলে যাওয়ার উদাহরণ আছে। গত শীতে রাজধানীতে বসবাসকারী শীতার্তদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার খরচ এ খাত থেকে নেয়া হয়েছে। আর যাদের টাকা বা সামগ্রী দেয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই আবার ঢাকায় চলে এসেছে।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ছয় বছর আগে নেয়া সরকারের উদ্যোগটি এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাজেট থাকা সত্ত্বেও থমকে গেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচীর আওতায় নেয়া প্রকল্পের জন্য সরকার ২৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। অথচ এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর একজন ভিক্ষুককেও পুনর্বাসিত করা হয়নি। উল্টো ভিক্ষুকদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে যুক্ত ১০টি এনজিওর বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ১৭ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় সরকারও কর্মসূচীতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। গত ছয় বছরে বরাদ্দ কমেছে ২০ গুণ। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। ভিক্ষুকদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ২০১১ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ১০টি জোনে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ করা হয়। তবে নীতিমালায় ভিক্ষুকের সংজ্ঞা, বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক সক্ষমতা-অক্ষমতার মতো বিষয়গুলো স্পষ্ট না করায় জরিপটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। উপরন্তু, আবেদনকারী ৪০টিরও বেশি এনজিওর মধ্যে যে ১০টি এনজিও এ জরিপ পরিচালনার কাজ পায়, তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না বলে সংসদীয় কমিটি মনে করে। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে তিন সদস্যের উপ-কমিটি গঠন করে। মূলত তখন থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের ঢিলেমি ও অনীহা দেখা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য জানান, ফলপ্রসু না হওয়ায় সরকারও কর্মসূচী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতিবছর কমছে বরাদ্দের পরিমাণ। কর্মসূচী শুরুর অর্থবছর (২০১০-১১) বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১১-১২) এর পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় ১০ কোটি টাকা। এরপর থেকেই বরাদ্দের পরিমাণ ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ কোটি ও চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাত্র ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। গত অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ১ কোটি টাকার মধ্যে একটি টাকাও ব্যয় হয়নি। আর চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নাম প্রাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা শহরের একজন ভিক্ষুকের গড় দৈনিক আয় এক হাজার টাকার বেশি। বিনা পরিশ্রমেই এ টাকা আয় হয়। আর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ মাত্র ৬৭ টাকা। তাই যারা একবার লজ্জা ও আত্মসম্মানের কথা ভুলে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়, তাদের এর থেকে নিবৃত্ত করা অনেক কঠিন।
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (কার্যক্রম-২) বেগম সৈয়দা ফেরদাউস আখতার ইনকিলাবকে বলেন, এ প্রকল্প নিয়ে আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না। সকালে এসে বলে ভিক্ষা করবো না। দুপুরে দেখা যায় ভিক্ষা করছে। এরা আসল অভাবী ভিক্ষুক নয়, এরা ব্যবসায়ী ভিক্ষুক। এদের প্রত্যেকের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে। কিছু হলে এদের আত্মীয়-স্বজন চলে আসে অঙ্গীকারনামা সই করে নিয়ে যায়। তারপর আবার চলে আসে।
তিনি বলেন, আগামী মাস থেকে রাজধানীতে আবারো অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম শুরু হবে। ঢাকায় এলাকাভিত্তিক অবস্থান, স্থায়ী ঠিকানায় সামাজিক মর্যাদা, ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দিষ্ট পেশা অবলম্বনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনায় রাজধানীতে বসবাসরত ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল।
ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি সমাজসেবা অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা গত এপ্রিল মাসে গোপালগঞ্জে ২০ লাখ টাকা দিয়েছে। সুনামগঞ্জে ৭ লাখ টাকা, নড়াইল এবং ময়মনসিংহে মোট ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন