বুশরা বিবি। বয়স এই মুহূর্তে ৪৮। ইমরান খানের স্ত্রী। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে বিয়ে হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ক্রিকেটের বিশ্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ইমরান ২৫ বছর আগে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। নাম পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই। ইমরানের বয়স যখন ৬০ পার হয় তখন তিনি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আধ্যাত্মিক সাধক বলে যাদের পরিচিতি, তাদের সঙ্গ তার ভালো লাগতে শুরু করে। ৪০ বছরে পা দেওয়ার আগেই বুশরা বিবির আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। তার নাম ছিল বুশরা মানেকা। যখন তার আধ্যাত্মিকতার কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে তখন মানুষ তাকে বুশরা বিবি বলে ডাকতে শুরু করে। তিনি ধীরে ধীরে মহিলা মুর্শিদ বা মহিলা পীর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তার খ্যাতির কথা শুনে ইমরান তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বুশরা বিবির দরবারে যাতায়াত শুরু করেন। এরমধ্যে বুশরা বিবি কয়েকজন নামজাদা লোক সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং সেগুলো ফলে যায়। বুশরা বিবি আপাদমস্তক বোরখায় নিজেকে আবৃত রাখেন। বোরখা আবৃত অবস্থাতেই ইমরান খান তাঁর দরবারে যাতায়াত করতেন।
‘দি নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’ পাকিস্তানের একটি বহুল প্রচারিত বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই এই দৈনিকটির রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, তার বাংলা অনুবাদ: বিশ্বস্ত সূত্র এই বিষয়টি প্রকাশ করেছে যে, ঐ বছর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন এবং ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ও ভবিষ্যৎ-বক্তা (Clairvoyant) বুশরা বিবির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনের অনেক আগেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ঐ নির্বাচনে (২০১৮) ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই) ১১৬টি আসন পাবে। নির্বাচন শেষে দেখা গেল, ১৪৯টি আসন পেয়ে পিটিআই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইমরানের সাথে বিয়ের আগে তিনি এসব প্রেডিকশন করেছেন। ইমরানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছে ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। আর পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই।
ভারতীয় পত্রিকা ‘ন্যাশনাল হেরাল্ডের’ ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই সংখ্যায় রিপোর্ট করা হয়েছে, ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর ইমরানের ঠান্ডা মাথায় দল পরিচালনা এবং ধীশক্তি দেখে তৎকালীন প্রখ্যাত বলিউড অভিনেতা আয়ুস্মান খুরানা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘ইয়ে বান্দা পাক্কা একদিন পাকিস্তানকা পিএম বানেগা’। ২৬ বছর পর বলিউড অভিনেতা খুরানার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি ইমরান খানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অশুভ সংকেতও রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের’ ২০১৮ সালের ২ আগস্ট একটি চাঞ্চল্যকর কিন্তু ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছেন ভারতের কিংবদন্তি টক শো হোস্ট সিমি গারওয়াল। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগেই ইমরান যে, জনসমর্থন লাভ করেছিলেন তাতে তার দলের বিজয় প্রত্যাশিত ছিল। সিমি গারওয়াল তার বহুল প্রচারিত টক শোতে ইমরানের সাক্ষাৎকার নেন। ঐ সাক্ষাৎকারে ইমরান খান সিমি গারওয়ালকে বলেছেন যে, এক পীরনি (মহিলা পীর) (বুশরা বিবি) তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তেমনি সেই একই পীরনি আততায়ীর হাতে তাঁর (ইমরানের) নিহত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। সিমি গারওয়াল তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে এই তথ্য প্রকাশ করেন। ঐ টুইটার বার্তায় বলা হয়, # #ImranKhan I’m deeply ambivalent about the victory. It’s a poisoned chalice! Many years ago @ImranKhanPTI told me that a pir had predicted he will become PM of Pakistan one day – and will be assassinated. Seems Imran wanted it.. despite the cost.. Its sad. 11:54 pm - Simi Garewal (@Simi_Garewal) July 25, 2018. বাংলা অনুবাদ, ‘ইমরান খান। তার বিজয় সম্পর্কে আমি দারুণ অনিশ্চিত। এই বিজয় বিষমিশ্রিত মদ। অনেকদিন আগে @ইমরান খান পিটিআই আমাকে বলেছিলেন যে, একজন পীর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, একদিন তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তারপর আততায়ীর হাতে নিহত হবেন। মনে হয়, ইমরান এটাই চেয়েছিলেন... যদিও তার মূল্য অনেক চড়া... এটা খুবই দুঃখজনক।’
মানুষ দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে বলে সিমি গারওয়াল ঐ টুইটার বার্তা মুছে দিয়েছেন। আমরাও ইমরানের দীর্ঘ জীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি। কিন্তু গত ১৩ মে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে লক্ষ লোকের বিশাল জনসমুদ্রে ইমরান খান যে আতঙ্কজনক তথ্য প্রকাশ করেছেন, সেটি সমগ্র পাকিস্তান জাতির জন্য একটি ভয়াবহ অশনিসংকেত। ঐ জনসভা বা জলসায় তিনি বলেছেন যে, তাকে হত্যা করার চেষ্টা চলছে। হত্যা চেষ্টার প্রমাণসহ একটি ভিডিওচিত্র তিনি তার কাছে রেখেছেন। তবে এটি একটি নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এই হত্যার ষড়যন্ত্রে যারা যুক্ত আছে তাদের সবার নাম তার কাছে আছে। এই হত্যা ষড়যন্ত্রের কিছুটা তিনি আগেই জানতেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমি পুরোটা জেনেছি। যদি আমার কিছু ঘটে যায় তাহলে পাকিস্তানিদের কাছে এই ভিডিও প্রকাশ করা হবে। সেক্ষেত্রে শুধু পাকিস্তানিরাই নন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং পাকিস্তানের বাইরে কারা এই হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল দুনিয়াবাসী তা জানতে পারবে। এই কুচক্রীরা তাকে পথের কাঁটা মনে করে।
১৪ মে মর্দান শহরে অপর একটি বিশাল জনসভায় ইমরান খান সরকারকে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছেন এই বলে যে, যদি তার কিছু ঘটে এবং এরপর যখন এই ভিডিওটি প্রকাশিত হবে তখন পাকিস্তানের কোটি কোটি জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবে। ইমরান খানের মন্ত্রিসভার সদ্যবিদায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ বলেন, আমরা যারা এই মঞ্চে উপবিষ্ট আছি তারা এবং এই বিশাল জনসভার একটি বিশাল অংশ কাপ্তান সাহেবের অনুসারী। তার জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত। যদি কাপ্তান সাহেবের কিছু হয় তাহলে দেশদ্রোহী এবং লুটেরাদের সেভাবে বিতাড়িত করা হবে, যেভাবে শ্রীলংকার লুটেরা সরকারকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পূর্বে আমেরিকা পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চেয়েছিল। এই ঘাঁটি থেকে তারা পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে আফগানিস্তানে হামলা চালাবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান আমেরিকার এই আবদার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বক্তব্য, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার সাথে জড়িত হওয়ার ফলে পাকিস্তানকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে। আমেরিকার পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে ৮০ হাজার পাকিস্তানিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমাদের উপজাতীয় এলাকাগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই নতুন করে তাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পাকিস্তানের আরো ক্ষতি হোক, সেটা আমি চাইনি। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমেরিকার সাথে আমার সমস্যা। এরপরে আমেরিকা লন্ডনে নওয়াজ শরীফ এবং পাকিস্তানে জারদারিদের সাথে শলাপরামর্শ শুরু করে। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে একটা কিছু ঘটতে চলেছে।
এর পরেই মার্কিন ডলারে পাকিস্তানে কোটি কোটি টাকা আসতে শুরু করে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে ওরা আমার দুই একটি কোয়ালিশন পার্টনারকে বাগিয়ে নেয়। সিন্ধু হাউসে নগদ টাকার লেনদেন চলে এবং আমার দলের ২০ জন সদস্যকে ওরা কিনে নেয়। এর সাথে যুক্ত হয় নতুন দুটো ঘটনা। একটি হলো পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ওসমান বুজদার এবং আইএসআই প্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাভীদ আনজুমের নিয়োগ নিয়ে।
যেদিন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট পাস হয় সেই রাতে, রাত ১২টার কিছুক্ষণ আগে ইমরান খানের সরকারি বাসভবনে একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে আসেন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া এবং আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নভীদ অনজুম। তারা সরাসরি ইমরান খানের কক্ষে প্রবেশ করেন। ইমরান খান মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর এই দুই আগন্তুককে আশা করেননি। তিনি এটাও জানতেন না যে, সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ান ইতোমধ্যেই তার বাসভবন ঘিরে ফেলেছে।
এ পর্যন্ত ইমরান খান যতগুলি ঐতিহাসিক জনসভা করেছেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ২০ মের পর তিনি পাকিস্তানের জনগণকে ইসলামাবাদ অভিমুখে লংমার্চ করার আহ্বান জানাবেন। তিনি প্রতিটি জনসভায় এই মর্মে আহ্বান জানান যে, তিনি চান, কমপক্ষে ২০ লক্ষ লোক যেন এই লংমার্চে সামিল হয়। তিনি বলেন, এই লংমার্চ ক্ষমতার রাজনীতির কোনো অংশ নয়। এটি হলো ২২ কোটি পাকিস্তানির জিহাদ। এই লংমার্চের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা শুরু করবেন বিপ্লব। বিভিন্ন জনসভায় ইমরান খান তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছেন। আমি সেই ভাষাগুলি অবিকৃত রাখবো। শুধু তার বাংলা অনুবাদ করে দেব। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি বলেছেন, ওরা ঃযরবভ. তার বাংলা হলো চোর। আমি এভাবেই তাঁর বক্তৃতায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর বাংলা করবো।
ইমরান খান তার এই প্রস্তাবিত লংমার্চকে বলেছেন, আজাদী মার্চ। অর্থাৎ স্বাধীনতার মার্চ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের নিকট থেকে পাকিস্তানিরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের মীরজাফর, মীর সাদিক এবং লুটেরারা আমেরিকার হুকুমে সেই স্বাধীনতা হরণ করেছে। ২০ মের পরে যে লংমার্চ বা আজাদী মার্চ হবে সেটি হবে আমেরিকার নিকট থেকে হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার মার্চ।
ইমরান খানের ভাষায়, এই স্বাধীনতা হরণ শুরু হয় তখন থেকে, যখন আমেরিকা ২০ বছর ধরে দখলদারিত্ব রাখা সত্ত্বেও ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হয়। ইমরান খান বলেন যে, আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার পর আমেরিকা পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চেয়েছিল। এই সামরিক ঘাঁটির উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তান থেকে কোনো সন্ত্রাসী হামলা পরিচালিত হলে পাকিস্তানের ঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা যেন পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারে।
ঠিক একই সময়ে ইসলামাবাদে গভীর রাতে সুপ্রিম কোর্টের সিংহ দুয়ার খুলে যায়। প্রধান বিচারপতি ওমর আতা বান্দিয়াল ফুল বেঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তার কাছে একটি দরখাস্তে বলা হয় যে, কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনাপ্রধান কামার বাজওয়াকে বরখাস্ত করেছেন। বান্দিয়াল বসে আছেন ঐ বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করতে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয় না। এর মধ্যে আমেরিকা, ‘এস্টাবলিশমেন্ট’, বান্দিয়াল এবং শরীফ ও ভুট্টোদের সম্মিলিত চক্রান্তে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে।
লিয়াকত আলী খানকে প্রকাশ্য জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রধান নায়ক হওয়ায় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। বোমা বানানোর পরিকল্পনা থেকে সরে না আসায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের বিমান মাঝ আকাশে বিধ্বস্ত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ড আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। এখন দেখতে হবে, ইমরান খানের নসিবে কী লেখা আছে।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন