চারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এবং প্রকল্প ব্যয় তিন গুণের বেশি করার পরও কাজ শেষ হয়নি চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সড়কটি যান চলাচলের জন্য সীমিত আকারে খুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনটি ফিডার রোডের (সংযোগ সড়ক) একটিরও নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। ফলে আড়াই হাজার কোটি টাকায় সড়কটি নির্মাণের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। নগরীর বাসিন্দাদের বিমানবন্দর যেতে হচ্ছে হাটহাজারী-বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সড়ক ঘুরে রিং রোড হয়ে। পতেঙ্গা সৈকত কিংবা বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথেও দীর্ঘপথে দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সড়কে এখনই ভারী যানবাহনের চাপ বাড়ছে।
আগামী জুলাই মাসে চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল-পিটিসি। এটি চালু হলে কন্টেইনারবাহী ভারী যানবাহন চলাচল বাড়বে রিং রোডে। এ বছরের শেষ দিকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হতে পারে দেশের প্রথম টানেল কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। আগামী জানুয়ারি নাগাদ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা বিশ্বরোড অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৪ সালে আংশিক চালু হতে পারে চট্টগ্রাম বন্দরের মেগা প্রকল্প বে-টার্মিনাল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতেঙ্গা এলাকাকে ঘিরে সরকারি এ চারটি মেগা প্রকল্প চালু হলে আউটার রিং রোড সব ধরনের যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। রিং রোডের সঙ্গে এ চারটি বড় প্রকল্পের পরিকল্পিত সংযোগ, প্রবেশ কিংবা নির্গমন কাজের সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পটি দিয়ে সুবিধার পরিবর্তে যানজটসহ নতুন জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে সড়কটি পুরোদমে চালুর আগেই তার উপযোগিতা হারাতে বসেছে। পতেঙ্গাকে ঘিরে একাধিক মেগা প্রকল্পের সঙ্গে আউটার রিং রোডের সংযোগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা জানিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
কর্ণফুলী টানেলের উভয় প্রান্তে ট্রাফিক রুট নির্মাণ সংক্রান্তে গঠিত কমিটির এক সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, পিটিসি, বে-টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু টানেল কিংবা নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে এসব গাড়ির চাপ পড়বে আউটার রিং রোডের ওপর। এত গাড়ির চাপ এ রোডের পক্ষে বহন সম্ভব নয়। বৈঠকে রিং রোডের ফিডার রোড দ্রুত নির্মাণের পাশাপাশি ওই এলাকায় যানজট নিরসনজনিত সঙ্কট মোকাবেলায় টানেল অ্যাপ্রোচ রোড ও দুই লেনের একটি সার্ভিস সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। ওই বৈঠকের পর সার্ভিস রোড নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ফিডার রোড নির্মাণে এখনো কোন অগ্রগতি নেই। নানা জটিলতার কারণে সবকটি রোডের কাজ থমকে আছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে সিডিএ কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হলেও সংস্থাটির প্রায় সব প্রকল্পই ত্রুটিপূর্ণ। সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়নেও লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বার বার প্রকল্প সংশোধন, নকশায় পরিবর্তন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ না করে নতুন করে প্রকল্প ব্যয় এবং সময় বাড়াতেই সিডিএর বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আরও কিছু কাজ সংযুক্ত করে দ্বিতীয় ধাপে (আউটার রিং রোড-২) আরেকটি প্রকল্প প্রহণের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
২০০৬ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) এক সমীক্ষায় চট্টগ্রাম নগরীর ভবিষ্যতের জন্য টেকসই যোগাযোগ অবকাঠামো বাড়াতে সমুদ্র তীরবর্তী একটি সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টার প্ল্যানেও শহরের আউটার রিং রোডের উল্লেখ করা হয়। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে শহররক্ষা বেড়িবাঁধের ওপর আউটার রিং রোড নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ। কিন্তু শুরুতে যথাযথ সমীক্ষা না করা, প্রকল্প এলাকায় সরকারি একাধিক মেগা প্রকল্পকে বিবেচনায় না নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পটির বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা যায়। আর শেষ সময়ে এসে এখন প্রকল্পের শতভাগ সুফল প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিগত ২০১১ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্টের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষর করে সিডিএ। তখন বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে। এখন ২০২২ সালে এসেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। নগরীর পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ কাট্টলী পর্যন্ত ১৫ দশমিক দুই কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণে তখন প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালী করা, নগরীতে যানজট কমানো, আবাসন-বাণিজ্য ও পর্যটন উৎসাহিত করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সড়কটি নির্মাণ করা হয়।
২০১৩ সালের আগস্টে একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুলাইতে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। সেসময় সংশোধিত ব্যয় নির্ধারিত হয় এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। কয়েক দফায় বাড়িয়ে এখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। দুই বছর আগে মূল সড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে কোন সংযোগ সড়ক না থাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থায় তেমন সুফল আসছে না।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) তারেক আহম্মেদ বলেন, রিং রোডের সংযোগ সড়ক চালু না হওয়ায় ভারী যানবাহনগুলোতে অনেক দূর ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে নগরীর বিশেষ করে বন্দর-ইপিজেড, পোর্ট কানেকটিং রোড এলাকায় যানজটের তেমন উন্নতি হয়নি। কর্ণফুলী টানেল এবং বে-টার্মিনাল চালু হলে যানজট সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। মূল সড়কের পাশেই রাতারাতি ছোট বড় অসংখ্য কন্টেইনার ডিপো গড়ে উঠছে জানিয়ে তিনি বলেন, অপরিকল্পিত এসব স্থাপনার কারণে সড়কে যানজট এবং বিশৃঙ্খলা বাড়বে। বিষয়টি সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশনকে জানানো হয়েছে। তবে এসব বন্ধে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে না।
জানা যায়, শুরুতে নগরীর সঙ্গে সড়কটির সংযোগ স্থাপনে স্টিলমিল নারিকেলতলা-বেড়িবাঁধ, বড়পোল-আনন্দবাজার-বেড়িবাঁধ এবং সাগরিকা-স্টেডিয়াম-বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় শুরুতে একটি রোড বাতিল করা হয়। একটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট অংশে ফিডার রোডের-৩ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। তবে সেখানে রেললাইন থাকায় রেল কর্তৃপক্ষ ফ্লাইওভারের উচ্চতা নিয়ে আপত্তি দেয়। তাতে থমকে যায় ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ।
সরেজমিন দেখা যায়, ফিডার রোড না থাকায় বন্দর ও বিভিন্ন কন্টেইনার টার্মিনাল থেকে পতেঙ্গা হয়ে আউটার রিং রোডে উঠতে হয় পণ্যবাহী ভারী যানবাহনকে। পাশাপাশি নগরীতে প্রবেশের জন্য টোল রোড ধরে ফৌজদারহাট হয়ে ঘুরে আসতে হয়। দক্ষিণ কাট্টলীর খেজুরতলা ঘাট এলাকায় টোল রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আউটার রিং রোড। সেখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত টোল রোডে গাড়ির চাপ বেড়েছে।
প্রকল্প পরিচালক সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ ও নানা জটিলতার কারণে ফিডার রোড নির্মাণ শেষ করা যাচ্ছে না। তবে খুব শিগগির এসব রোড চালু করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কর্ণফুলী টানেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে রিং রোডের উপর যানবাহনের চাপ বাড়বে স্বীকার করে তিনি জানান, এ লক্ষ্যে রিং রোডে চার লেনের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হচ্ছে।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও রিং রোডের সংযোগস্থলে আট লেনের সার্ভিস রোড করা হবে। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামাল দিতে আগামী জানুয়ারির মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত আট কিলোমিটার খুলে দেয়া হবে। এছাড়া আউটার রিং রোডকে আরও বেশি কার্যকর করতে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ব্যাপারে আউটার রিং রোড ফেস-২ নামে একটি প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন