মাইক্রোবাসের ভিতরে থাকা সবার হাতে হাতে অস্ত্র, ওয়াকিটকি ও মোটা লাঠি। পুরোদস্তুর পুলিশ-র্যাব সদস্যদের মতো তাদের ভাবভঙ্গি। ব্যস্ততম সড়কে গাড়ির গতিরোধ করে তল্লাশির নামে টার্গেট করা লোকদের মাইক্রোবাসে তুলে প্রকাশ্যেই মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করছে চক্রটি। এভাবেই অপরাধীদের হাতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সমাগ্রী চলে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই অপহরণ, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ নানা দুর্ধর্ষ অপরাধ করছে বিভিন্ন চক্র। এমনকি অবৈধ মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামার, রিপিটার ও মোবাইল বুস্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা যন্ত্রও রয়েছে এসব অপরাধীদের হাতে।
র্যাব ও পুলিশ এ ধরনের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করলেও বন্ধ হচ্ছে না তাদের তৎপরতা। যদিও প্রায় সময়ই অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক ওয়াকিটকিসহ নানা সামগ্রী জব্দ করে র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। জব্দ হওয়া এসব ওয়াকিটকির চালান সবগুলোই বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই আমদানি করা হয়েছিল। খোদ রাজধানীতেই ওয়াকিটকি যেভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা সামগ্রী বিক্রির দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও তা দেদার বিক্রি হচ্ছে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাপ ও জ্যাকেটসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি খোলা বাজারে বিক্রি হওয়ার সুযোগে সংঘবদ্ধ একটি চক্র এসব জোগাড় করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে। যার দায় পুরোটাই তাদের (আইন-শৃংখলা বাহিনীর) ঘাড়ে চাপছে। তবে কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অর্থলোভে পড়ে এ দলে ভিড়ছে বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। গত ১৮ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত বিটিআরসি’র এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন টিম ও র্যাবের এর যৌথ অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট থেকে বিপুল পরিমাণ অনুমোদনহীন জ্যামার, বুস্টার ও রিপিটারসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। যা রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের।
গত রোববার রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় আইটিস্টল ডট কম বিডি নামে ই-কমার্স ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে অবৈধ জ্যামার, বুস্টার এবং রিপিটার বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে বিটিআরসি এবং র্যাব-৩ এর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে চারটি জ্যামার, তিনটি বুস্টার, চারটি এসি অ্যাডাপ্টর, ২৪টি জ্যামার এন্টিনা, নয়টি পাওয়ার ক্যাবল বুস্টার এর আউটডোর এন্টিনা, ২৬টি বুস্টার এর ইনডোর এন্টিনা, ৩৭টি বুস্টার এর ক্যাবল, একটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। এসময় দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এসব ঘটনায় দেশের নিরাপত্তা হুমকির উল্লেখ করে র্যাব-৩ এর সিও লে. কর্নেল আরিফ বলেন, সাধারণ মানুষ ওয়াকিটকি বহনকারী কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবেই গণ্য করে। এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করে অপরাধীরা ভুয়া ডিবি, র্যাব, ডিজিএফআই ও এনএসআই সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করতে গেলে জনসাধারণ তাদের ভুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভেবে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া ওয়াকিটকির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপরাধ সংগঠন করলে পরবর্তীতে অপরাধী শনাক্তকরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, উদ্ধার করা ওয়াকিটকি সেটের ফ্রিকোয়েন্সি ২৪৫-২৪৬ মেগাহার্জ। এসব ওয়াকিটকি ব্যবহার করে রিপিটার ছাড়া অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব। এছাড়াও বহুতল ভবনের মধ্যে উপরতলা থেকে নিচতলায় যোগাযোগ করা সম্ভব। এসব ওয়াকিটকির দাম পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত। ব্যাটারির চার্জ ধারণের ক্ষমতা অনুযায়ী ওয়াকিটকির দামের তারতম্য হয়ে থাকে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপরাধ সংগঠন করলে পরে অপরাধী শনাক্তকরণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। যা সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিটিআরসি সুত্রে জানা গেছে, কোনো ব্যক্তিকে ওয়াকিটকি ব্যবহারের লাইসেন্স দেয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানকে এই লাইসেন্স দেয়া হয়। সরকারি সংস্থার বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শর্তসাপেক্ষে ওয়াকিটকি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। আর কালো রঙের ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারি সংস্থাই কেবল ব্যবহার করতে পারে।
সূত্র মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সরকারি সংস্থার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে জন্য দ্বিমুখী বেতার যন্ত্র ওয়াকিটকি হাতে দেখা যায়। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষের হাতে অহরহই চোখে পড়ছে যন্ত্রটি। এই বেতারযন্ত্র ব্যবহারের চেয়ে প্রদর্শনেই এরা ব্যস্ত থাকে বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের সম্মান, দুর্বলতা বা ভয়ভীতি রয়েছে, সেসব সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ওয়াকিটকিধারী পেশাদার অপরাধীরা। ওয়াকিটকি হাতে থাকা ব্যক্তিদের আচরণে ভড়কে যান সাধারণ মানুষও। কারণ তাদের হাবভাবে মনে হয়, তারা যেন পুলিশ বা গোয়েন্দা কর্মকর্তা! আইনের তোয়াক্কা না করেই প্রতারণার ফাঁদ পাতায় ব্যবহৃত হচ্ছে এ যন্ত্রটি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১-এর ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া দেশের ভূখণ্ড, সমুদ্রসীমা বা আকাশসীমায় বেতারযন্ত্র স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং নজরদারির অভাবে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে রেডিও ওয়েভ ওয়াকিটকির অবৈধ ব্যবহার। আইনটির ৫ ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস, কোস্টগার্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীসমূহ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজনে বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫৫ (১) ধারা প্রযোজ্য হবে না।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মোবাইল ট্র্যাকিং ডিভাইস এবং ওয়াকিটকির মতো স্পর্শকাতর প্রযুক্তি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রযুক্তি সন্ত্রাসী-অপরাধীরা ব্যবহার করলে তা হবে দেশ ও জনগণের জন্য বড় হুমকি ও উদ্বেগের। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন নিরাপত্তা এ বিশ্লেষকরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবির প্রধান হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, বিটিআরসি’র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানই কেবল এই কালো রঙের ওয়াকিটকি আমদানি করতে পারে। কিন্তু অবৈধ পথে এসব ওয়াকিটকি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া আমারও এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন