উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেনার অঙ্ক বেড়েই চলেছে শ্যামপুর সুগার মিলের। দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ মিলটিতে নেই আগের মত কর্মচাঞ্চল্য, শ্রমিক-চাষি কিংবা দর্শনার্থীদের আনাগোনা। সন্ধ্যা হলেই মিল এলাকায় সৃষ্টি হয় ভূতুড়ে পরিবেশ। অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান মেশিনপত্র। ব্যবহার না করায় রোদ-বৃষ্টিতে মরিচা ধরে ভেঙ্গে-খুলে পড়ছে একের পর এক ট্রাক্টর। লোকসান ঠেকানো এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান বজায় রাখতে বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের প্রস্তাব লাল ফিতায় বন্দি। ফলে পাওনা টাকা না পেয়ে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
১৯৬৪ সালে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর এলাকায় প্রায় ১৪৫ একর জমির ওপর নির্মিত হয় শ্যামপুর সুগার মিল। রংপুর অঞ্চলের একমাত্র ভারি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে মাড়াই শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। মিলটির দৈনিক আখ মাড়াইয়ের ক্ষমতা ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। সে হিসেবে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন। আখ মাড়াই মৌসুমে মিলটি চালু থাকে মাত্র তিন মাস।
চালুর পর থেকেই মিলটি লাভের মুখ দেখলেও কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অব্যাহত অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারনে ২০০০ সাল থেকে টানা লোকসানের মুখে পড়ে। ব্যাংক ঋণ, ঋণের সুদ, বকেয়া বেতন ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন খাত মিলে শেষ পর্যন্ত লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৫ কোটি টাকা। এ অবস্থায় শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি মিলটির মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে মিলের কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।
মিল সূত্রে জানা গেছে, মিলটি চালু থাকা অবস্থায় ৪৯৩ জন স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। বন্ধের পর অনেকেই অবসর গ্রহণ করেছেন এবং কিছু জনবল অন্য মিলে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে এই চিনিকলে ১০৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছেন। শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ৭ কোটি, গ্রাচ্যুয়িটি প্রায় ১১ কোটি এবং বেতন প্রায় ৪ কোটি টাকাসহ প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, লোকসানের অজুহাতে প্রায় ১ বছর আগে বন্ধ করে দেয়া মিলটি এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মিল এলাকায় পড়ে রয়েছে সব মেশিন পত্র ও পরিবহনগুলো। ফাঁকা জমিতে শ্রমিকরা ভুট্টা, আলু ও ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করছেন। মেশিনগুলোতেও মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাইরে পড়ে থাকা আখ পরিবহনে ব্যবহৃত অসংখ্য ট্রাক্টর রোদ-বৃষ্টিতে মরিচা ধরে ভেঙ্গে খুলে পড়ছে। রাতের আধারে দুস্কৃতিকারীরা মেশিনসহ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলোর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীদের কথা, মিলটি বন্ধের পর থেকে এর মূল্যবান সম্পদগুলো নষ্ট হওয়া ছাড়াও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। যে যেভাবে পারছে যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই মিল এলাকায় বসে মাদক সেবিদের আড্ডা।
এসব বিষয়ে মিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিদের মধ্যে বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দাবি, মিল এলাকায় আখ উৎপাদন কমে যাওয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে লোকসানের বোঝা বাড়ছে। কিন্তু এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিরা। তারা বলছেন, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। এ নিয়ে আন্দোলনও শুরু করে চিনিকল অ্যামপ্লয়ীজ ইউনিয়ন ও আখ চাষি কল্যাণ সমিতি।
মিলের একাধিক শ্রমিক জানান, বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে তারা মানবেতর জীবন করছেন। বিকল্প আয়ের উৎস না থাকায় এই চাকরির উপরই অনেকেই নির্ভরশীল। প্রথম দিকে ধার দেনা করে সংসার চালালেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। দেনার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চরম আর্থিক সমস্যা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
মিলের অফিস সহকারি আমিনুল জানান, গত বছরের জুন থেকে বেতন বন্ধ। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসের বেতন পেলেও বাকি নয় মাসের বেতন বন্ধ রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেকানিক্স নুরুল ইসলাম জানান, তিন বছর আগে অবসরে গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পাননি। নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আখ চাষ করলেও এখন মিল বন্ধ থাকায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।
মিলের জেনারেল ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, প্রায় ১ বছর থেকে কর্মচারীদের বেতন বন্ধ রয়েছে। আমরা ঢাকায় হেড অফিসে তাগাদা দিলে তারা শুধু বলছেন সরকার টাকা দিলে ব্যবস্থা হবে। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ মো. আহ্সান হাবিব জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম একটি ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্যামপুর সুগার মিল। মিলের সাথে জড়িত ছিল কয়েক হাজার পরিবার। কিন্তু মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিদের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মিলটি উৎপাদনমুখী করতে এবং বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মিলের নিজস্ব জায়গায় আলুর কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন এবং পিপি ব্যাগ ও চিনির প্যাকেট তৈরির কারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা গত বছরের নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে তা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে গেছে। মন্ত্রণালয় সেটি যাচাই করছে।
মন্তব্য করুন