লাগামহীন দরবৃদ্ধির ফলে আগেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে গরু-খাসি ও মুরগির গোশত। কম খরচে আমিষের চাহিদা পূরণে একমাত্র অবলম্বন ছিল ডিম। এখন এই পণ্যও রীতিমতো দরবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়েছে অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যের প্রোটিনের এ উৎসটি। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা। গত সপ্তাহে এক ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হয় ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। একই ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা দরে। সে হিসেবে একটি ডিমের দাম পড়ে ১১ টাকা। সংরক্ষণজনিত ঝামেলার কারণে গরমের সময়টাতে ডিমের দাম কিছুটা কম থাকে, কিন্তু এ বছর মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ডিমের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। অন্যদিকে ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষোভ ক্রেতাদের।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে লাল ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। বাজারে হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৯০ টাকা। ডিমের দাম বাড়লেও ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমেছে। প্রতি কেজি সাদা ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়, যা গত সপ্তাহেও ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। আর প্রতি কেজি লাল ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৯০ টাকা। গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকায়। খাসি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। গত সপ্তাহে এ দুই ধরনের গোশত একই দামে বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর কচুক্ষেত বাজারে এক ক্রেতা ডিম কেনার সময় বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো কিছুই হাতের নাগালে নেই। ডিমের অবস্থাও একই। সবকিছু শুধু হুহু করে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ না খেয়ে মরবে।
একই বাজারে সবজি কিনতে এসে বেগুনের দাম শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় রেজাউল করিমের। কেজি ৮০ টাকা শোনার পর তিনি দেখেশুনে দুটি গোল বেগুন দেখিয়ে ওজন করতে বললেন বিক্রেতাকে। দাম এলো ৩৫ টাকা। দুটি বেগুন কেন কিনলেন-এর জবাবে তিনি বলেন, এখন ৮০ টাকা দিয়ে এক কেজি বেগুন কেনার সামর্থ্য আমার নেই, তাই দুটি বেগুন ওজন দিয়ে ৩৫ টাকায় কিনেছি।
দেশে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের নিত্যপণের দাম বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে পারছে না শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে রেজাউল করিমের মতো কৌশল নেন কেউ কেউ। কেউ আবার খাবারে মাছ-গোশত কমিয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন। আবার দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ডিম, ডাল জোটানোও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে মাছ-গোশতের বাজারে ক্রেতা কমেছে বলে জানালেন বিক্রেতারা।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাড্ডা কাঁচাবাজার ও কচুক্ষেত বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাল, ডাল, আটা, ডিম, সবজি ও মাছ-গোশতসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দামই চড়া। পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া ছাড়া ২০০ টাকা কেজির নিচে বাজারে কোনো মাছ নেই। বাজারে যেসব রুই-কাতলা মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোর ওজন দেড় কেজি থেকে তিন কেজির বেশি। ফলে রুই-কাতলা মাছ কেনার সামর্থ্য অনেকের নেই। ছোট মাছের মধ্যে কাঁচকি ৪০০ টাকা ও মলা মাছ ৩৫০ টাকা কেজি।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সংসারের ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ক্রেতারা এখন বাজার করায় কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করছেন। আগে যে ক্রেতা কেজি হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও সবজি কিনতেন, তাদের মধ্যে অনেক ক্রেতাই এখন কেজি হিসেবে পণ্য না কিনে অল্প পরিসরে কিনছেন। যারা আগে বড় মাছ কিনতেন, তারা তুলনামূলক কম দামে ছোট মাছ কিনছেন। গরু-খাসির গোশত না কিনে মুরগির গোশত কিনছেন।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. আমজাদ হোসাইন বলেন, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা মুরগির গোশত কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ঈদের আগে দৈনিক ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি মুরগি বিক্রি করা যেত, এখন সর্বোচ্চ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি মুরগি বিক্রি করতে পারছি। আগে যারা ব্রয়লার পছন্দ করতেন না, তারাও এখন খরচ কমাতে দেশি ও সোনালি মুরগি না কিনে ব্রয়লার কিনছেন।
বাজার খরচ বাঁচাতে অনেকেই মাছ-গোশত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এমন একজন রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী ফিরোজা খাতুন। মধ্য বাড্ডার কাঁচাবাজারে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে সপ্তাহে এক দিন হলেও গরুর গোশত খাওয়া হতো। ঈদ চলে গেছে ২০ দিনের বেশি হবে, কিন্তু গরুর গোশত খাওয়া তো দূরের কথা, সোনালি মুরগি খাওয়ারও সাহস করতে পারছি না। কারণ বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই বাজার খরচ কিছুটা বাঁচাতে মাছ-গোশত কমিয়ে দিয়েছি। বিভিন্ন গোশতের দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোশত বিক্রি খুবই কমে গেছে। আগে দৈনিক দু-তিনটি গরু বিক্রি করা যেত। এখন সারা দিনে একটি গরু বিক্রি করাও কঠিন হয়ে গেছে।
ঈদের পর রাজধানীর বাজারে সব ধরনের চালের দাম তিন থেকে আট টাকা বেড়েছে। গতকাল খুচরা বাজারে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মিনিকেট ৭০ টাকা, কাটারি ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫ টাকা। আটা-ময়দা কেজিতে প্রায় ১০ টাকা বেড়ে খোলা আটা ৫০ টাকা, প্যাকেট (দুই কেজির) আটা ৯৬ টাকা, প্যাকেট ময়দা ৬৩ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শসা প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। লম্বা বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা আর গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, চায়না গাজর প্রতি কেজি ১৬০ টাকা, চাল কুমড়া পিস ৫০ টাকা, প্রতি পিস লাউ আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, পটল ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, পেঁপের কেজি ৫০ টাকা, বটবটির কেজি ৮০ টাকা, ধুনধুলের কেজি ৭০ টাকা, মটরশুটির কেজি ১২০ টাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন