শান্তির ধর্ম ইসলাম সবধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসী কর্মকা- কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। সন্ত্রাসী তৎপরতা ও আগ্রাসী হামলা প্রতিরোধে প্রয়োজনে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে কোরআন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয়।’ (সূরা বাকারা : ১৯৩।) বহিঃশত্রু ও অভ্যন্তরীণ শত্রুর আক্রমণ থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সব ধর্মই স্বীকার করেছে এবং এর বৈধতাও দিয়েছে। কোনো স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে সীমানাপ্রাচীর ভেঙে শত্রু কর্তৃক নির্যাতিত-নিপীড়িত ও আক্রান্ত মানুষের মুক্তি সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জানমাল ও জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা যে সংগ্রাম করা হয়Ñ ইসলামের পরিভাষায় সেটাই প্রকৃত ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ। তাওহিদ বা একাত্ববাদ প্রচার ও আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) জিহাদ বা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ করেছেন। এভাবে ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধসহ আরো অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ইসলামে যেমন ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী শান্তিচুক্তি বা সন্ধির পথও দেখিয়েছে। রাসূল (সা.) এবং মুশরিকদের মাঝে সংঘটিত ‘হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তি’-এর উজ্জ্বল প্রমাণ।
ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। ইসলামের আগমনে রক্তপাত ও হানাহানির অবসান ঘটে। পবিত্র কোরআন এবং রাসূল (সা.)-এর বাস্তব প্রশিক্ষণ যুদ্ধপ্রিয় একটি জাতিকে অল্পসময়ের ব্যবধানে শান্তিপ্রিয় জাতিতে পরিণত করে। কোনো দেশে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করা ইসলাম স্বীকৃত। কারণ ইসলামের সমরনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। রাসূল (সা.) কখনো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করেননি। কেবল আত্মরক্ষার্থে রাসূল (সা.)-কে জীবনে অনেক যুদ্ধ, সংলাপ, সন্ধি ও শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে। ইসলামের যুদ্ধনীতি হলোÑ ‘মুসলমানদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় অধিকার রক্ষার তাগিদে যতটুকু সংগ্রাম করা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই যুদ্ধ করা যাবে।’ কেননা মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাতকে সমর্থন করে না। যেখানে ‘যুদ্ধ’ মানেই বিভীষিকা, মৃত্যু, ধ্বংস, সেখানে ইসলামের উদার যুদ্ধনীতিতে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতারণা করা যাবে না, বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না, নিহত ব্যক্তির অঙ্গচ্ছেদ করা যাবে না, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবে না, শত্রু হলেও প্রার্থনারত অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করা যাবে না, ফলদায়ী গাছ কাটা যাবে না।’ (তারিখ তাবারি।)
অহেতুক হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ-বিগ্রহে বহু দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। নিকট অতীতে যেসব দেশে যুদ্ধের দামামা বেজেছে ওইসব দেশে দুর্ভিক্ষ, দারিদ্রতা, অজ্ঞতা, জেঁকে বসেছে। অর্থনৈতিক এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কাঙ্খিত মান ফিরিয়ে আনতে পারেনি অধিকাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তাই মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে বিভিন্ন দেশে বিরাজমান যুদ্ধ সংকটের আশু নিরসনের জন্য শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় উপনীত হয়ে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠার প্রহর গুনছে। যুদ্ধ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কারণ হলোÑ কেউ কাউকে মেনে নিতে পারে না। কারো প্রস্তাবে কেউ রাজি হয় না কিংবা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব হারাতে চায় না। তাই তো যুদ্ধ আজ বিশ্বব্যাপী। আমরা ধ্বংসাত্মক এটম চাই না। শান্তি বিস্ফোরণ চাই। এমন পৃথিবী চাই যেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি। কারণ, মানব মন শান্তির প্রতি সংবেদনশীল। কিন্তু অহংকার নামক ব্যাধির কারণে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা শান্তির পায়রাটিকে বাঁধন খুলে দিতে পারেন না অনেকেই। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রের মোকাবেলা নয়। বুদ্ধি দিয়ে বুদ্ধির মোকাবেলা। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। যুদ্ধের মাধ্যমে যে শুধু যুদ্ধরত দুটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নয়; প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই নতুন করে আমরা কোনো যুদ্ধ দেখতে চাই না। বিশ্বমোড়লদের কাছে জিজ্ঞাসাÑ ‘যুদ্ধ কি ভাই শান্তি আনে, নাকি আনে মুক্তি? বাড়ায় শুধু দ্বন্দ্ব-বিভেদ, বয়ে আনে অপূরণীয় ক্ষতি। পারমাণবিক বোমা কিংবা আছে বিধ্বংসী অস্ত্র যত, নাস্তানাবুদ কতশত জনপদ, মানবতা হচ্ছে ক্ষতবিক্ষত। হে বিশ্বনেতা, চাইনা যুদ্ধ, চাই শান্তি, সমঝোতায় আনতে পারে মুক্তি, লেলিয়ে না দিয়ে কাউকে কারো প্রতি উভয়ের মাঝে করে দিন শান্তিচুক্তি।’
লেখক : খতিব, মনিপুর বাইতুর রওশন জামে মসজিদ মিরপুর, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন