॥ শেষ কিস্তি ॥
ড.ড হান্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭৫৭ সালে পূর্বে ৮০ হাজারের উপরে কওমী মাদ্রাসায় ছাত্র অধ্যয়ন করত। এ সমস্ত খালেচ দ্বীনি প্রতষ্ঠান থেকে বিজ্ঞ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফতি, মুনাজির তথা মহান আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীদের এক উল্লেখযোগ্য বিশাল জামাত প্রতিনিয়ত বের হচ্ছেন। কিন্তু কওমী মাদ্রাসাসমূহ থেকে পাস করা ছাত্রদের দাওরায়ে হাদিসের সনদের রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি ও মান নেই। একটি স্বাধীন দেশের জন্য এটা শুধু পরিতাপের বিষয় নয়, লজ্জাজনকও বটে। বেফাকুল মাদারিস ও ইত্তেহাদুল মাদারিস কর্তৃক প্রদত্ত দাওয়ায়ে হাদিসের সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকার কারণে এক দিকে লাখ লাখ ইলমে নববীর ধারক-বাহক দ্বীনি ছাত্রদের মেধা ও প্রতিভার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, অন্যদিকে মেধা অপচয় ও পাচার হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে জাতিও প্রতারিত হচ্ছে। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও অত্রযাত্রায় কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রাশাসন, বিচার, শিক্ষা, প্রতিরক্ষাসহ প্রতি সেক্টরের দ্বার কওমী মাদ্রাসা পড়–য়াদের জন্য আজ রুদ্ধ, অর্গল যুক্ত। অত্যন্ত সুকৌশলে এদেরকে যবনিকার অন্তরালে রাখা হয়েছে। অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে ডিগ্রি ও সনদ মূল বিবেচ্য বিষয় নয়, জ্ঞানই বিবেচ্য। এ বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তবে এ সত্যকেও অস্বীকার করা যাবে না যে, জ্ঞান তথা প্রতিভার অবমূল্যায়ন হলে নতুন সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার জন্ম হয় না। বাজারে যে পদার্থ ও দ্রব্যের চাহিদা কম, তার উৎপাদন হ্রাস পেতে বাধ্য। বর্তমানে বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিতরাই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর নিয়ন্তা ও চালিকা শক্তি। একই দেশে পাশাপাশি দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যে পর্বত প্রমাণ বৈষম্য বিদ্যমান। এক জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শাসক, বিচারক হচ্ছেন, অপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হচ্ছেন শাসিত ও মগলুব। এ দৃশ্য অসহ্য ও হৃদয়ে আঘাত হানার মতো। যা মেনে নেওয়া যায় না।
বিভিন্ন দেশে কওমী সনদের স্বীকৃতি
পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বেফাকুল মাদারিসের সভাপতি মরহুম হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ (রহ.)-এর প্রাণন্তকর প্রয়াস ও সংগ্রামের মাধ্যমে তাঁদের দাওরায়ে হাদিসের সনদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ আরবি ও ইসলামিয়াতের সমমানের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন।
পাঞ্জাবের গভর্নর ১৯৮৬ সালের ২০ মার্চ জারিকৃত এম ও (গণশিক্ষা) ৯-৮/৮৪ নম্বরের এক নোটিফিকেশনে ইসলামাবাদস্থ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নোটিফিকেশনের নং ৪১৮/একা ৮৪/৬ ভুল্যম ৭/২২৭ তারিখ ০৩/০২/১৯৮৫ উদ্ধৃতি সনদ দিয়ে ঘোষণা করেন যে, দ্বীনি মাদ্রাসা সমূহের বেসরকারি বোর্ডকর্তৃক প্রদত্ত দাওরায়ে হাদিসের শাহাদাতুল “আল-জামিয়া ফি উলুমিল আরাবিয়াহ্ ওয়াল ইসলামিয়াহ্” এমএ আরবি ও ইসলামিয়াত বিষয়ে শিক্ষকতা ও উক্ত বিষয়দ্বয়ে উচ্চতর গবেষণা করার ক্ষেত্রে সমমান পাবে। শিক্ষকতা ছাড়া অন্য যে কোন বিভাগে চাকরির বেলায় উক্ত সনদধারীকে আরবি ও ইসলামিয়াত ছাড়া ¯œাতক পর্যায়ে অতিরিক্ত যে কোন দুইটি বিষয়ে পাস করতে হবে। ফলে পাকিস্তানি কওমী মাদ্রাসা পড়–য়া মেধাবী ছাত্র ভাইয়েরা উলুমুত-তাওহীদ, উলুমুল-কোরআন, উলুমুল-হাদিস, উলুমুল-কানুন ওয়াশ-শরীয়াহ্, উলুমুত-তারীখ আল-ইসলামিয়া ওয়াস সাকাফাহ প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মক্কার উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিফলীর দাওয়াহ কলেজ ও কুয়ালালমপুরের আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছেন। এ সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তানের কওমী মাদ্রাসার ছাত্রগণ সেনা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করার ব্যাপক সৌভাগ্য লাভ করে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাচ্ছে সর্বত্র। প্রক্ষান্তরে ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের ফাজিল সনদ এবং লক্ষরোউর দারুল উলুম নদওয়ার আলমীয়ত সনদ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃত। উক্ত প্রতিষ্ঠান দ্বয় থেকে পাস করা ছাত্রগণ আলী গড় বিশ্ববিদ্যালয় এম এতে লক্ষেèৗ, কালিকট, এলাহাবাদ করাচী কাশ্মীর ওসমানীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করছেন।
কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি নাগরিক অধিকার
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি আমাদের জন্মগত নাগরিক অধিকার। কোন হাদিয়া বা তোহফা নয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো সরকারিভাবে অস্বীকৃত। প্রদত্ত সনদও অগ্রহণযোগ্য। যারা এ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করেন তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? যে কোন নাগরিকের শিক্ষা-দীক্ষাসহ সব নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কি সরকারের দায়িত্ব নয়? স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারগুলো কি কোন খবর নিয়েছেন, সরকারের কানা কড়ি ব্যয় বিনে সম্পূর্ণ জনগণের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত এ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্তরা সরকারি স্বীকৃতি পাবার যোগ্য কি-না? প্রকৃতপক্ষে এরাই নির্ভেজাল খালেছ ইসলামী শিক্ষার ধারক-বাহক ও অকৃত্রিম দেশ প্রেমিক সু-নাগরিক। সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক শর্ত জুড়ে দেয়া হলে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা তার ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র হারাবে। তা কিন্তু বাংলার তৌহিদী জনতার কাম্য নয়। তাবে হ্যাঁ সরকারি পৃষ্টপোষকতায় দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞ আলমে দ্বীন, ওলমা-মাশায়েখে সমন্বয়ে নতুন ক্যারিকুলাম প্রণয়নের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। কওমী মাদ্রাসার মূল ক্যারিকুলাম “দরসে নেজামী” দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলুখ লৌক্ষèসহ পাক-ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত এবং পরিশীলিত সুষম হয়েছে। মৌলিক বিষয়াবলী বহাল রেখে ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলী বাদ দিয়ে ইসলামী চাহিদার ভিত্তিতে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে বহু নতুন বিষয় সন্নিবেশিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে কমিশন গঠনের মাধ্যমে আরও সুবিন্যস্ত সুষম করা যেতে পাবে। স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নামে একটি শিক্ষা বোর্ডও গঠন করা যেতে পারে। এ বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক বোর্ডের অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা নেয়া হবে। কওমী বলয়ের সাংগঠনিক অবকাঠামো চোখে পড়ার মত না হলেও তাদের রয়েছে এক বিশাল বেমেছাল জনশক্তি। আর এদের শিক্ষার মূল উৎস হচ্ছে এদেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহ। কওমী মাদ্রাসা সমূহকে স্বীকৃতি দিয়ে সুবিধাজনক স্থানে একটি অ্যাফেলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন স্বতন্ত্র কওমী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে মাদ্রাসা শিক্ষার উচ্চস্তরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত স্বচ্ছ, সুন্দর, চরিত্রবান সালেহীন সমৃদ্ধ জাতি গঠন করা সম্ভব।
এদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোয় উচ্চশিক্ষার দ্বার অবারিত করা এবং নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, সুষম, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রচেষ্টায় সরকার এগিয়ে আসবে সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা এবং সময়ের দাবি।
ঘুরে দাঁড়াতে হবে
শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রের আগ্রহ দক্ষ মানব শক্তির পূর্বশর্ত। পৃথিবীর বহু সভ্যতার ভৌগোলিক অবস্থাগত বিলুপ্তি হলেও মানবিক বা দার্শনিক সম্পদ অবিনাশী হয়ে আছে কেবলমাত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির কারণেই। মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির সময় এসেছে। সময়টা অল্প, কিন্তু মূল্যবান। নিজের ভাগ্য নিজেকেই পরিবর্তন করতে হয়।
মানকুলাত এবং মাকুলাতরে সমন্বয়ে দ্বীনি শিক্ষা যত দিন অব্যাহত ছিল তত দিন পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহ্র স্থান ছিল সর্ব শীর্ষে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে রাসূল (সা.)-এর সময় থেকে পরবর্তী সহস্র বৎসর কাল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিম উম্মাহ্ এমন অপরাজয়ে উৎকর্ষ লাভ করেছিল এবং তা অব্যাহত গতিতে চলছিল তৎকালীন বিশ্বে নয়, আধুনিক প্রেক্ষাপটেও বিস্ময় ও সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলে। হযরত উমর ফারুক (রহ.) সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক, খালিদ বিন ওয়ালিদ শ্রেষ্ঠতম সমর কুশলী, তারিক বিন জিয়াদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন দিগি¦জয়ী সিপাহসালার। হযরত আবু হানীফা (রহ.) শুধুমাত্র ইমামে আজম নন; তিনি ছিলেন সমসাময়িক বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নগর পরিকল্পনাবিদ যার তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিল বাগদাদ নগরী।
মুসলিম উম্মাহ যদি আবার তার হৃত গৌরব ফিরে পেতে চায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গণমুখী ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। দ্বিতীয় আর কোন পথ নেই। আলামা ইকবাল বলেছেন “মুসলমান যদি নতুন করে সততা ইনসাফ হেকমত ও হিম্মতের সবক গ্রহণ করতে পারে, সে আবার সম্মানে পৃথিবীর নেতৃত্বে আসীন হবে।
অতএব কোন দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে সকল প্রতিবন্ধকতা পরাভূত করে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রয়োগিক রূপ দান করতেই হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন