রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বদলে গেছে পতেঙ্গা

টানেল টার্মিনাল এক্সপ্রেসওয়ে রিং রোড-মেগা প্রকল্প বহরে

রফিুকল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন গতি : ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আমদানি-রফতানি উন্নয়ন-বিনিয়োগ পর্যটনে : পুরোপুরি সুফল পেতে প্রয়োজন
সমন্বিত উদ্যোগ
বদলে গেছে পতেঙ্গা। পতেঙ্গায় বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকায় চারটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে পতেঙ্গাকে ঘিরে। আরো কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর অপেক্ষায়। মেগা প্রকল্প বহরে সাগর সৈকত পতেঙ্গা এখন চট্টগ্রামের সাথে সারাদেশের যোগাযোগের কেন্দ্র। পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির কাছে চীনের সহযোগীতায় দশ হাজার কোটি টাকায় দেশের প্রথম টানেল কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ প্রায় শেষ। চিটাগাং ড্রাই ডকের পাশে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দরের আরেক মেগা প্রকল্প পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল-পিটিসি।

সেখানে আগামী জুলাই মাসে জাহাজ ভেড়ার কথা রয়েছে। আগেই যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭শ কোটি টাকায় নির্মিত সিটি আউটার রিং রোড। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকায় পতেঙ্গা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর-ইপিজেড হয়ে মহানগরীর লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজও দ্রæত এগিয়ে চলছে।

এর ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের যোগাযোগে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর কেন্দ্রীক আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনসহ এই অঞ্চলে উন্নয়ন, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়েছে। পতেঙ্গার অদূরে সাগর তীরে গড়ে উঠছে আগামীর বন্দর খ্যাত বে-টার্মিনাল। লালদিয়ার চরে আরো একটি কন্টেইনার টার্মিনাল করার পরিকল্পনা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের। সিটি আউটার রিং রোড হয়ে চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে সাগরের তীর ঘেঁষে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত উপক‚লীয় মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল মীরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর বিশাল এলাকায় গড়ে উঠা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সাথে বন্দরের সংযোগ হবে সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে।

কর্ণফুলীর ওপারে দেশের প্রথম এসব সর্ববৃহৎ বেসরকারি ইপিজেড কোরিয়ান ইপিজেড ছাড়াও আনোয়ায় প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সেতু বন্ধন রচনা করবে পতেঙ্গা গড়ে উঠা টানেল। চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদীর দুইপাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতেই টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তায়ন করছে সরকার। এই সুরঙ্গ পথ চালু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজারের সাথে সড়ক পথে যোগাযোগ আরো সহজতর হবে। বাঁশখালীর গÐমারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি স্টেশন তথা এনার্জি হাবসহ মেগা প্রকল্প বহরের সাথে চট্টগ্রাম তথা দেশের বিভিন্ন এলাকার সংযোগ ঘটবে পতেঙ্গা হয়ে।

ফলে আগামী দিনে এই পতেঙ্গাকে ঘিরে আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্পায়নসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাÐের বিরাট অংশ পরিচালিত হবে। পর্যটনের জন্য ব্যাপক পরিচিত পতেঙ্গা এই অঞ্চলের যোগাযোগের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হচ্ছে। উত্তাল সাগরের তীরে ছয় লেনের সড়কসহ নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলীর তীরে পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য আরো বেশি বিকশিত হয়েছে। বিনোদন, পর্যটন ও আবাসন খাতে অপার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ইতোমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে সাগর তীরে বিশ্বমানের একটি স্মার্ট সিটি নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এদিকে পতেঙ্গাকে ঘিরে মেগাপ্রকল্প বহরের পুরোপুরি সুফল পেতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। অদূর ভবিষ্যতে পতেঙ্গা তথা চট্টগ্রামকে ঘিরে ব্যাপক এবং বিকাশমান অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বিবেচনায় টানেলসহ সংশ্লিষ্ট সড়ক অবকাঠামোকে আগামী ১০০ বছরের উপযোগি করে গড়ে তোলার জন্য নতুন পরিকল্পনারও পরামর্শ আসছে।

পাকিস্তান আমল থেকে শিল্প অঞ্চল হিসাবে পরিচিত পায় পতেঙ্গা। দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারি ১৯৬৮ সাল থেকে জ্বালানি তেল পরিশোধন করে আসছে। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিও পতেঙ্গায়। পতেঙ্গায় আছে চিটাগং ড্রাই ডক, টিএসপি কমপ্লেক্স, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টিল মিল এলাকায় গড়ে উঠা কর্ণফুলী ইপিজেডসহ সরকারি বেসরকারি অনেক শিল্প কারখানা, শিপ ইয়ার্ড। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো। পতেঙ্গার অদূরে দেশের সর্ববৃহৎ ইপিজেড চট্টগ্রাম ইপিজেড। নদীর ওপারে রয়েছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড-সিইউএফএল, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিডেট-ফাকফোসহ অনেক ভারী শিল্প কারখানা।

পতেঙ্গায় আউটার রিং রোড চালু হয়েছে। খুব শিগগির চালু হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। আগামী জানুয়ারির মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে বন্দর নিমতলা বিশ্বরোড অংশ খুলে দেয়া হবে। আর তখন ওই এলাকায় যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে। তাতে যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পতেঙ্গামুখি বিমান বন্দর সড়ক, কাটগড় সড়ক এবং আউটার রিং রোডের পাশে অপরিকল্পিতভাবে বেসরকারি ডিপো এবং বাস, ট্রাক ও ভারী যানবাহনের টার্মিনাল গড়ে উঠায় যানজটের আশঙ্কা আরও প্রবল হয়ে উঠছে। টানেলের উত্তর প্রান্ত বা শহরের দিক থেকে পাঁচটি সড়ক দিয়ে টানেলে যাওয়া যাবে- আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাঠগড় ও এয়ারপোর্ট সড়ক এবং পতেঙ্গা সৈকত সড়ক দিয়ে টানেল সড়কে গিয়ে প্রবেশ করবে।

এর ফলে টানেলের প্রবেশ পথে যানজট জটলা থেকে অচলাবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, টানেলসহ এসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বিষয়টি নিয়ে স্টাডি এবং চট্টগ্রাম বন্দর, সিডিএ ও সড়ক বিভাগসহ সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। তা না করায় এখন এসব প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, পতেঙ্গা টার্মিনাল চালু হলে সেখান থেকে কত সংখ্যক ভারী যানবাহন চলাচল করবে, টানেলে কত সংখ্যক যানবাহন চলবে কিংবা বে-টার্মিনালে কত যানবাহন আসবে তার একটি হিসাব করেই ওই এলাকার সড়ক ব্যবস্থাপনা তৈরী করতে হবে। তা না হলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।

জানা গেছে টানেল ঘিরে যানজটের শঙ্কার বিষয়টি মাথায় রেখে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের নেতৃত্বে ‘বঙ্গবন্ধু টানেলের উভয়প্রান্তে ট্রাফিক রুট নির্মাণ’ নিয়ে কমিটি করা হয়। এই কমিটির বেশ কয়েকটি বৈঠকে টানেলের আশপাশের সড়কে একাধিক এপ্রোচ রোড তৈরি করার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করতে বলা হয়।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, অদূর ভবিষ্যতে টানেল ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলে পতেঙ্গা এলাকায় যানজট তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কার বিষয়টি আমাদের বলা হয়েছে। এটা মাথায় রেখেই টানেলের প্রবেশ পথে আলাদা লেইন তৈরী করা হচ্ছে। সিটি আউটার রিং রোডেও সার্ভিস লাইন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো প্রকল্প নেওয়া হবে। আউটার রিং রোড মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন