শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ওলিদের আল্লাহপ্রেম

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

যার ইমান ইয়াকিন যত মজবুত আল্লাহর ভালবাসা তার তত গাড় নিঁখুত। আল্লাহর চাওয়া তার চাওয়া হয়ে যায়। আল্লাহকে পাওয়াই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়। তার কাজ, তার ঘুম, তার আহার, তার চলাফেরা সব মহান রবের জন্য, সে তখন কোরআনের ভাষায় বলে, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাবিবল আলামীন, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী আমার জীবন আমার মরণ সব কিছু মহান আল্লাহকে নিবেদিত। আল্লাহর প্রিয়দের জীবন আমাদের চলার আলোকবর্তিকা। তাদের জীবনী আমাদের চলার পথকে সহজ সাবলীল করে দেয়।
হযরত সালামা ইবনে দিনার (আবু হাযেম) রাহঃ মদিনায়। খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক মদিনায় এলেন। সালামা ইবনে দিনার রাহঃ কে বললেন, শায়খ আমাকে নসিহত করুন। সালামা রাহঃ বললেন, আল্লাহকে ভয় করুন। দুনিয়া বিমুখ হয়ে যান। কারণ দুনিয়ার হালালের জন্য রয়েছে হিসাব আর হারামের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।
এক বাদশাহ তাকে বলল, আপনার কোন প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলুন, সালামা রাহঃ বললেন, দূর হও। তোমার কাছে আসার আগেই আমার প্রয়োজন আমার মালিককে বলেছি। তিনি যা দিয়েছেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করছি। আর যা দেননি তাতে আমি সন্তুষ্ট আছি।
এক ব্যক্তি সালামা রাহঃ প্রশ্ন করল, আপনার সম্পদ কী? তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহর উপর ভরসা আমার সম্পদ। আর মানুষের স¤পদের প্রতি নির্মোহতা। তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেন, যে সকল কাজের কারণে মৃত্যুকে ভয় পাও এই কাজগুলো ছেড়ে দাও, তখন মৃত্যুকে তুমি আর ভয় পাবে না। তিনি আরোও উপদেশ দিতেন, পাপাচার বেড়ে গেলে যদি নেয়ামত বেড়ে যায়, তবে মনে করো ঘুড়ির রশিতে টান দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
খলিফা সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের সময়। খলিফা হজ্জে এলেন, মদিনা মনাওয়ারা জেয়ারতে এলেন, তার আসাতে গন্যমান্য ব্যক্তিগন তার সাক্ষাতে ছুটে গেল। খলিফা জানতে চাইলেন, মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগনের সান্যিধ্য প্রাপ্ত কেউ আছে কি না। তাকে জানানো হলো একজন আছেন, তিনি হলেন সালামা ইবনে দিনার (আবু হাযেম) রাহঃ। খলিফা তার খেদমতে দূত প্রেরণ করলেন, তার সাক্ষাত লাভের আকাংখা পেশ করলেন, আবু হাযেম রাহঃ তাশরীফ আনলেন, তখন দু জনের মাঝে কথা হচ্ছে।
খলিফা বললেন, এ কেমন অসৌজন্যমূলক কাজ? আবু হাযেম রাহঃ বললেন, আপনি আমার মধ্য এমন কী দেখলেন যা অসৌজন্যমূলক? খলিফা বললেন, আমি মদিনায় আসাতে সকল গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আমার সাক্ষাতে এসেছেন, কিন্তু আপনি আসলেন না। আবু হাযেম রাহঃ জবাবে বলেন, হে আমিরুল মুমিনিন, যা অবাস্তব এমন কথা বলা থেকে আমি আপনাকে আল্লাহর আশ্রয় সমর্পন করছি। আসল কথা হল, ইতিপূর্বে আপনি আমাকে জানতেন না, আর আমিও আপনাকে কোন দিন দেখি নি। এমতাবস্থায় আপনার সাথে সাক্ষাতের কথা অবান্তর। এটা অসৌজন্যমূলক কিভাবে হলো? আবু হাযেম রাহঃ এর কাছ থেকে এমন উত্তর পেয়ে খলিফা উপস্থিত সকলের দিকে তাকালেন। তখন ইমাম জুহরী রাহঃ বললেন, আবু হাজেম তো যথার্থই বলেছেন। তখন খলিফা অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে দেন।
খলিফা বলেন হে আবু হাযেম রাহঃ আমি কেন মৃত্যুকে ভয় করি? জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, আপনি দুনিয়াকে আবাদ করছেন, আর আখিরাতকে বরবাদ করেছেন। আবাদকে ছেড়ে বরবাদের প্রতি মনে টান না থাকাই স্বাভাবিক।
খলিফা আবার প্রশ্ন করলেন, হে শায়খ, পরকালে মহান মালিকের দরবাবে কিভাবে হাজির হতে হবে? আবু হাযেম রাহঃ জবাবে বলেন, কোন মুসাফির দীর্ঘ সফরের পর ফিরে আসলে প্রিয়জনদের সাথে যেভাবে মিলিত হওয়ার তাগাদা অনুভব করে, নেককার লোকেরা এরচেয়েও আরো অধিক আনন্দের সাথে আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। অন্যদিকে কোন পলাতক গোলামকে যেভাবে গ্রেফতার করে মালিকের সামনে হাজির করা হয়। ঠিক তেমনি পাপিদেরকে গ্রেফতার করে আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে। এ কথা শোনা মাত্র খলিকা কান্না করতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, হায় আমি যদি জানতে পারতাম, মহান রব আমার জন্য পরকালে কী ব্যবস্থা রেখেছেন? এর জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, আপনার কাজগুলোকে কোরআনের কষ্টি পাথরে বিচার করুন। তাহলে মহান রব আপনার জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছেন, তা জানতে পারবেন। তখন তিনি কোরআনুল কারীমের আয়াত পাঠ করেন, ইন্নাল আবরারা লাফি নাঈম ওয়া ইন্নাল ফুজজারা লাফি জাহিম। অর্থ- নিশ্চই নেককারগন জান্নাতে সুখ সম্পদে বসবাস করবে আর বদকার লোকেরা দোযখে বসবাস করবে। তখন খলিফা বললেন, আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত রহমত তো অসীম তা বদকার ও নাফরমানদেরও বেষ্টন করে আছে। জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, ইন্না রাহমাতাল্লাহি কারিবুম মিনাল মুহসিনিন। নিশ্চই আল্লাহ তায়ালার রহমত নেককার লোকদের অতি নিকটবর্তী।
খলিফা প্রশ্ন করলেন, আল্লাহ পাকের বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী কে? আবু হাযেম রাহঃ জবাব দেন যে বান্দার মধ্যে পরিপূর্ণ শালীনতা, মানবতাবোধ আছে, যে কঠিন জ্ঞানের অধিকারী ও প্রকৃত বিবেকবান। খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, সর্বোত্তম কাজ কোনটি? আবু হাযেম রাহঃ জবাব দেন, হারাম কাজগুলো বর্জন করা এবং ফরজ কাজগুলো যথাযথ ভাবে পালন করা। খলিফা সুলাইমান বলেন, কোন দোয়াটি সর্বোত্তম? আবু হাযেম রাহঃ বলেন, দাতার জন্য দান গ্রহিতার দোয়া। খলিফা জানতে চান সর্বোত্তম দান কোনটি? জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, নিজের খুবই প্রয়োজন, নিজের অনটন থাকা সত্ত্বেও সাহায্য প্রার্থীকে দান করা এবং দান গ্রহিতাকে কোন কষ্ট না দেওয়া এমন কি দানের উল্লেখ করে তাকে লজ্জিত না করা।
খলিফা বললেন, কোন কথাটি সর্বোত্তম? আবু হাযেম রাহঃ বলেন, যে ক্ষমতাশালী, যার ভয়ে ভীত থাকতে হয়, যার নিকট কোন কিছু পাওয়ার আশা করা হয়, তার সামনে নির্ভিক চিত্তে সত্য কথা প্রকাশ করা। খলিফা আবার বলেন, কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং ভাল মুসলমান কে? জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, যে ব্যক্তি সব সময় আল্লাহ তায়ালার অনুগত থাকে এবং অন্যকেও আল্লাহ তায়ালার অনুগত থাকতে উৎসাহিত করে। এবার খলিফা বলেন, মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ কে? জবাবে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার ভাইকে কোন জুলুমের কাজে সাহায্য করে অর্থাৎ নিজের দ্বীনকে বিলিয়ে দিয়ে অপরের জাগতিক স্বার্থ উদ্ধার করে।
খলিফা সুলাইমান বলেন, আপনি সঠিক বলেছেন, তবে আমাদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? জবাবে আবু হাযেম রাহঃ বলেন, এই প্রশ্ন থেকে অব্যাহতি দানকে উত্তম মনে করি। তারপর খলিফা বলেন, আমাদেরকে কিছু নসিহত করুন। আবু হাযেম রাহঃ বলেন, আপনার পূর্ব পুরুষগন তরবারীর শক্তিতে ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন এবং জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের শাসন করেছেন। কিন্তু তারপরেও তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বড়ই আফসোস আপনি যদি এ বিষয় অবগত হতেন যে, মৃত্যুর পর তাদের অবস্থা কী এবং এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য কী?
আবু হাযেম রাহঃ এর কথায় জনৈক অনুচর বলল, হে আবু হাযেম তুমি ভুল মন্তব্য করেছ। আবু হাযেম বলেন, না তুমি ভুল বলছ। আমি সঠিক কথাই বলেছি। মূলত মহান রব আলেমদের থেকে এই অঙ্গিকার গ্রহণ করছেন, যে তারা মানুষের নিকট সত্য কথা প্রচার করবে। কোন অবস্থাতে সত্য গোপন করবে না।
সূত্র: তাফসীরে নুরুল কোরআন : মাওলানা মোঃ আমিনুল ইসলাম রাহ.; দুনিয়া বিমুখ শত মনীষী : মুহাম্মদ সিদ্দিক আল মিনশাভী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন