স্টালিন সরকার : বাংলা একাডেমির ঐতিহ্যবাহী বইমেলায় ঘুরে মনে হলো দেশে পাঠকের (ক্রেতা) চেয়ে লেখক বেশি। মেলায় প্রতিদিন যে হারে বই আসছে সে হারে বিক্রি হচ্ছে না। সাহিত্য তথা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কৃষি, কমিক্স, খেলাধুলা, বিজ্ঞানসহ হরেক রকমের বইয়ের পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এখানে-সেখানে। হালে জনপ্রিয় সেলফিসহ অসংখ্য এনজিও প্রকাশনাও কর্মযজ্ঞ নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক করে বই প্রকাশিত হচ্ছে। আলোচনা, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পথনাটক, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, স্ক্যানিং মেশিন, পুলিশের কড়া নিরাপত্তা, কয়েক গজ দূরে দূরে পুলিশের টেকপোস্ট Ñ সব মিলিয়ে এলাহি কা-। কিন্তু সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐতিহ্যের মেলায় যেন প্রাণ নেই। নিরাপত্তার কারণে অতিরিক্ত চেকিং, আর্চওয়ে, ওয়াচ টাওয়ার, বিভিন্ন স্পটে চেকপোস্টে নিরাপত্তা নিয়মশৃঙ্খলায় দর্শকদের নাস্তানাবুদ অবস্থা। সৃজনশীল-মননশীল মেলায় বাণিজ্যিকীকরণের কারণে শিল্প-সাহিত্যের সমঝদারদের মধ্যে বোহিমিয়ানের আবহ যেন হারিয়ে গেছে। কবিরদের আড্ডা, সাহিত্যিকদের গল্পকথা, জ্ঞানবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের চাপানওতোর নেই। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ হারিয়ে একুশের বইমেলা রূপ পেয়েছে বাণিজ্য মেলায়। মেলার ডেকোরেশন থেকে শুরু করে সব আয়োজন সবকিছুতেই বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া। দৃষ্টি যেদিকে যায় জ্বলজ্বল করে একটি ব্যাংক ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, জ্ঞানী-গুণী শিল্পের সমঝদারদের মাসব্যাপী বার্ষিক আড্ডা-আনন্দ-উল্লাসের ঐতিহাসিক একুশের বইমেলা শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যের কবলে পড়ে গেল? বাণিজ্য মেলা সবার জন্য; কিন্তু বইমেলা কিছু বিশেষ মানুষের জন্য। সে মেলাও গ্রাস করছে বাণিজ্যবৃত্তিক মনোভাব! জ্ঞানের মেলা, উদ্ভাবন-সৃষ্টির মেলা একুশের বইমেলায় যদি বিজ্ঞজনদের জম্পেশ আড্ডা আর রবীন্দ্রনাথের ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’ আবহ না থাকে তাকে কি সৃষ্টি সম্ভারের মেলা বলা যায়? বইমেলাকে কেন্দ্র করে কৌশলে মেলার আশপাশে বারোয়ারি মেলা বসানোর রহস্য কী?
অমর একুশে উপলক্ষে বাংলা একাডেমির বইমেলাকে ঘিরে সারাবছরের অপেক্ষার পাশপাশি কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডায় ফিরে যাওয়ার যে তীব্র আকাক্সক্ষা সেটা কি হারিয়ে যাবে? সৃষ্টির পর থেকেই পৃথিবীর সব মানবগোষ্ঠীই তাদের নিজ নিজ মনের ভাবের সৃজনশীলতা, চিন্তা-চেতনা কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া, ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিরহ প্রকাশ করে বইয়ের মাধ্যমে। উপন্যাস-কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-গানসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশের এই মাধ্যমই হচ্ছে সাহিত্য। যে জাতির ভাষা, সাহিত্য সমৃদ্ধ সে জাতি তত সমৃদ্ধ। লেখকরা বছরভর অপেক্ষা করেন বইমেলার জন্য। অথচ বইমেলার আয়োজকরা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা-পর্যালোচনা তুলে ধরার চেয়ে যেন লাভ-লোকসানের দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন। কেবল মেলার পরিসর বাড়িয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দীতে নিলেই কি মেলার আভিজাত্য বাড়ে? না কি এ পিছনে ভিন্ন কোনও কারণ আছে? দেশের রাজনীতি কার্যত দুই ধারায় বিভক্ত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ভোটের কারণে রাষ্ট্রের একমাত্র রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সে চিন্তা থেকেই কি সুকৌশলে বাংলা একাডেমির ঐতিহ্যের বইমেলা দুই ভাগ করা হচ্ছে? তা নাহলে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের যে কোনো মেলা প্রাঙ্গণ থেকে অন্য মেলা প্রঙ্গণে যেতে দর্শকদের যে কাঠখড় পেহাতে হয়; যে পুলিশি বেষ্টনী পেরুতে হয় সে ধকল কতজন দর্শকের সহ্য করার ধৈর্য থাকে? আর নারী শিশুর পক্ষ্যে তা অসম্ভব। একজন লেখক বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, অতিরিক্ত তল্লাশি মেলার আবহ-বৈচিত্র্য নষ্ট করছে। নাতনিকে মেলায় নিয়ে আসা এক মহিলা পুলিশের তল্লাশি ও সর্বত্র পুলিশের উপস্থিতিতে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন, বাংলা একাডেমির এই মেলাকে বইমেলা না বলে ‘বাণিজ্যমেলা’ মেলা বলাই শ্রেয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রবেশ করেই প্রথমে চোখে পড়ল লোকে লোকারণ্য। কেউ বসে, কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা যায় র্যাবের কয়েক সদস্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তারা বলাবলি করছেন নকল বই ধরার জন্য তারা মেলায় যাচ্ছেন। দর্শকদের ঘোড়ায় উঠিয়ে টাকা নিচ্ছেন কয়েকজন পথ কিশোর। উদ্যান থেকে টিএসসিতে যাওয়াই দায়। এত মানুষ! হাজার ছেলে-মেয়ে-শিশু-বৃদ্ধা। পাথর সিমেন্টের তৈরি বিড়াট আকৃতির বাঘ টিএসটি চত্বরে। টিএসসি ও ডাস ঘিরে চুড়ি-ফিতার বারোয়ারি মেলা। শত শত দোকান হাজার পুলিশ। হৈচৈ শোরগোল মানুষের। মানুষ কেনাকাটা করছে। ‘ভালোবাসা দিবস’ হওয়ায় বিভিন্ন স্পটে ফুলের রিং বিক্রি হচ্ছে। মেয়েরা কিনে মাথায় দিয়ে ঘুরছেন। মেলা জমে গেছে। পা ফেলাই দায়। ধীরে ধীরে বইমেলায় দিতে গিয়ে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী স্পটের মেলায় প্রবেশ করতে হলো। পুলিশের তল্লাশির পর ভিতরে গিয়ে দেখা দেখা গেল চমৎকার চমৎকার প্যাভিলিয়ন ও দোকান সাজিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। কিন্ত দর্শন তেমন নেই। যারা মেলায় উপস্থিত হয়েছেন তারা হাঁটাহাঁটি করছেন। দীর্ঘ সময় সেখানে পায়চারি ও ঘুরে বই বিক্রি হতে দেখা গেল না। অথচ সুন্দর বাঁধাইয়ের বিভিন্ন লেখকের বই সাজিয়ে রেখেছেন প্রকাশকরা। হঠাৎ চোখে পড়লো ইমদাদুর হক মিলন একটি স্টলে দাঁড়িয়ে। দুইজন ক্রেতা বই কিনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অটোগ্রাফ দেবেন তাই টিভি ক্যামেরার জন্য অপেক্ষা করছেন। একসময় টিভি ক্যামেরা এলো। টিভির ক্যামেরার সামনে বইয়ে অটোগ্রাফ দিলেন প্রখ্যাত লেখক। প্রায় প্রতিটি বইয়ের স্টল দৃষ্টিনন্দন। সুপরিসর জায়গা থাকায় মানুষের চলাফেরায় অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুলিশের তল্লাশির পর নানা ভোগান্তির পর বাংলা একাডেমি স্পটে গিয়ে দেখা গেল বইয়ের দোকানগুলো যেন পুরান ঢাকার সরু ঘিঞ্জি গলির দোকানের মতো সাজানো। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে বটতলায় স্থায়ী মঞ্চে; কয়েকজন মিলে হৈচৈ, অথচ মেলায় দর্শক হাতে গোনা যায়। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে গিয়ে পুকুরের কালো পানি দেখে মনে হলো এ যেন শ্যামপুরের নর্দমার খাল। শিল্পকারখানা বর্জ্য পড়ে পুকুরের পানি কালো রং ধারণ করেছে। মেলা উপলক্ষে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা হয়নি। পাশেই খাবারের দোকানে লোকে লোকারণ্য। মতিঝিলের ঘরোয়া-হিরাঝিলে দুপুরে খেতে গেলে যেমন সিটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সেখানেও সে দৃর্শ্য। অর্থমন্ত্রী আর সাংস্কৃতিমন্ত্রী এসেছেন সে জন্য পুলিশের দৌড়ঝাঁপের মাত্রা কয়েকগুণ বেশি। বিকেল ৫টায় মেলায় ‘দর্শক গোনা যায়’ অবস্থা। কিন্তু হই-হুল্লোড়, হাঁকডাক, হৈচৈ চলছে সর্বত্র। অনুষ্ঠানস্থলে দিয়ে দেখা গেল প্রবীণ গবেষক অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্ব রামেন্দ্র মজুমদার মঞ্চে। সামনের চেয়ারে কয়েকজন দর্শক। তাদের বেশিরভাগ ঘুমাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো দর্শকের চেয়ে বেশি চেয়ার দখল করে বসে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে দুই দফায় বাংলা একাডেমি চত্বর চক্কর দেয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বইয়ের বেচা বিক্রী তেমন চোখে পড়ল না। ভিতরে সেলফি প্রতিযোগিতার দোকান খোলা হয়েছে। মেলায় হাকডাক থাকলেও দর্শনার্থী নেই বুঝতে পেরে আবার টিএসটির দিকে হাঁটা দিতে হলো। হায় আল্লাহ! সাপের খেলা দেখার জন্য মানুষ যেমন হুমড়ি খায় তেমনি অবস্থা টিএসটি, ডাস এলাকায়। বাদাম-বুট-সিঙ্গারা-খই-ভাপাপিঠার দোকান অসংখ্য। কোনোটা পুলিশ তুলে দিচ্ছে; আবার কোনোটা বসতে দিচ্ছে। কাউকে বসতে দেয়া ও কাউকে তুলে দেয়ার মাজেজা বোঝা না গেলেও বইমেলা উপলক্ষে সেখানে যে এলাহি কা- চলছে তা বোঝাই গেল।
বইমেলায় দৃশ্য পাল্টে গেলে মাগরিবের পর। সোয়া ৬টা থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী মেলায় প্রবেশ করতে শুরু করে। এ যেন জন¯্রােত। নিরাপত্তাজনিত কারণে আর্চওয়ের ভিতর দিয়ে প্রবেশের পর তল্লাশির কারণে মুহূর্তেই লাইন দুইশ-তিনশ গজ দীর্ঘ হয়ে যায়। হাজার হাজার দর্শনার্থী মেলায় প্রবেশ করছেন। মেলায় যারা প্রবেশ করছেন তাদের মধ্যে কিছু দর্শক মেলার বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখলেও অধিকাংশ হাজির হন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের নিচে। একাডেমি প্রাঙ্গণে গানের অনুষ্ঠান; আর সোহরওয়ার্দী উদ্যানে পথনাটক। দর্শকরা গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েকটি টিভি ক্যামেরা দেখা গেল সরাসরি সচিত্র খবর প্রচার করছে। টিভি ক্যামেরা দেখলেই দর্শকরা ছুটে যাচ্ছেন। গানের অনুষ্ঠানে আধা ঘণ্টা থেকে আবার ছুটতে হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পুলিশের প্রহরা ও তল্লাশি পেরিয়ে পথ নাটক স্থালে গিয়ে চোখ ছানাবড়া! উদ্যান কেটে নিচে নাটকের জন্য মঞ্চ ও স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে। হাজার হাজার দর্শক পথনাটক দেখছেন। ঘণ্টাখানের সেখানে নাটক দেখার পর বোঝা গেল পথ নাটকগুলো কার্যত সন্ত্রাস-দুর্নীতি-চুরি-ডাকাতি, গণতন্ত্র, ডাকাত-চোর, সমাজনীতি-রাজনীতি নির্ভর। দর্শক এই তালি দিচ্ছেন; হেসে কুটি কুটি আবার দু’চার মিনিট পর কাঁদাছেন; চোখের পানি ফেলছেন। পথনাটক আর দর্শক যেন একাকার হয়ে গেছেন। বস্তা চোরকে যেমন চিত্রায়িত করা হচ্ছে তেমনি বাজারে চাঁদাবাজদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। এ যেন দেশের প্রকৃত চিত্র। বাংলার সোঁদা মাটির ঘন্ধ। নাটকের শৈল্পিকতা, নান্দনিকতা, সমাজের কিছু ব্যক্তির চরিত্রের কদার্যতা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। পথনাটক দেখতে ভিড় জমিয়েছেন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-ছেলে ও বন্ধু-বান্ধব। উপচেপড়া ভিড়, তিল ধারণের ঠাঁই নেই; তারপরও বিশৃঙ্খলা নেই; সবাই যেন সবার পরমাত্মীয়। জায়গা না থাকার পরও একজন অন্যজনকে জায়গা করে দিচ্ছেন, কষ্ট করে সবে অন্যকে যেতে সহায়তা করছেন। কিন্তু বইমেলার দৃশ্যে তেমন পরিবর্তন চোখে পড়লো না। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সূর্যাস্তÍ পর্যন্ত যেমন ফাঁকা তেমনি রাতেও প্রায় তাই। অথচ সন্ধ্যায় দীর্ঘ লাইন ধরে দর্শন মেলার দুই স্পটে প্রবেশ করেছে। কারণ কি? জানতে চাইতেই এক তরুণী বললেন, ভাই পথনাটকে আমাদের জীবনের চিত্র দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বই কিনবেন কার? এখন সবাই লেখক। টাকা হলেই বই বের করছেন। দেশে ব্যাঙের ছাড়ার মতো লেখকের জন্ম হচ্ছে। কিন্তু পাঠ করার মতো বই পাবেন না। তবে যারা ভালো লেখেন তাদের বই বিক্রি হচ্ছে। তরুণীর স্বামী পরিচয় শুনে বললেন, ভাই দেখছেন কেমন দৃশ্য। ঐতিহ্যের বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি অথচ দেখে মনে হচ্ছে আয়োজক যেন আইএফআইসি ব্যাংক আর ইভেন্টার্স গ্রুপ। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা যা করছে তাকে কেউ একবার এলে আবার আসবে? নিñিদ্র নিরাপত্তা থাকা ভাল। মেলা এলাকাজুড়ে দুই শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে; রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। তারপরও তল্লাশির নামে হেনস্তা করা হচ্ছে কেন? কেন বইমেলার দর্শকদের মধ্যে ভীতি ছড়ানো?
বাংলা একাডেমির আয়োজনে একুশের বইমেলায় কলেবর বেড়েছে। সেমিনার-সংগীতানুষ্ঠানের সংযোজনে এসেছে বৈচিত্র্য। সেইসঙ্গে বেড়েছে বইয়ের স্টল, প্রসারিত হয়েছে দর্শক-শ্রোতা-ক্রেতার ভিড়। বই ছাড়াও ফুটপাতজুড়ে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের পণ্য, দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তানি কাপড়ের ব্যবহার। মাঠে ঘোড়ার পিঠে দর্শক ঘুড়িয়ে আয় করছে কিছু কিশোর। চা-বাদাম বিক্রেতা আছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট মনীষীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু বইয়ের স্টলে রকমারি প্রচ্ছদের অসংখ্য বই সারি সারি সাজিয়ে রাখলেও ক্রেতা তেমন নেই। দর্শক আসছেন বই উল্টেপাল্টে দেখছেন কিন্তু অধিকাংশই কিনছেন না। অথচ মিডিয়া কর্মীরা জানতে চাইলেই প্রকাশকরা বলে দেন বেচাবিক্রি ভালো। চার ঘণ্টায় একটি বইও বিক্রি করতে পারেনি এমন একটি স্টলের মালিক সাংবাদিকদের জানান, বেচাবিক্রি ভালো। অথচ পাশে থাকা বিক্রয় প্রতিনিধি মুখ ভার করে জানান, ভাই আজ একটিও বই বিক্রি হয়নি। তবে কিছু লেখকের বইয়ের বিক্রি বেশ ভালো বোঝা গেল। মিডিয়া গ্যালারি, লেখকের আড্ডা, এমন একাধিক জায়গা নির্ধারিত থাকলেও মেলা চলার অধিকাংশ সময় সেগুলো ফাঁকাই দেখা গেল। ঐতিহ্যের বইমেলায় আগে যে প্রাণ ছিল; লেখকের উপস্থিতি, লেখকের জন্য পাঠকদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার দৃশ্য, সেটা চোখে পড়ল না। এক হুমায়ূনের মৃত্যুই কি সব শেষ! আবার লেখকের বইয়ে সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, মননশীলতা, গোটা মানবসমাজের প্রতি ও নিজের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস ও উপলব্ধি সেটা যেন অনুপস্থিত। বইমেলায় নিত্যদিন প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে মান যাই হোক বই লেখার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সেটা বোঝা গেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপালনে থাকা দুইজন পুলিশ কর্মকর্তার কথাবার্তায়। মেলা থেকে বের হয়ে দোয়েল চত্বরের দিতে যাওয়ার সময় কানে এলো তাদের কথোপকথন। অল্পবয়সী ওই পুলিশ সদস্যের একজন বলছেন, দেখছো না হাজার হাজার বই। এগুলো কি পড়ার যোগ্য? অপরজন বলেন, মেলায় ¯্রােতের মতো বই আসছে। লেখকের সংখ্যা বাড়ছে গাণিতিকভাবে। বইমেলা এলেই বই বের করেন। এক সময় বাংলা সিনেমাও এমন দেখা গেছে। মেধাহীন অযোগ্য-অপদার্থরা ও সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে নি¤œমানের ছবি বানানোর কারণে ঢাকার সিনেমার ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ কোলকাতার সিনেমা এগিয়ে যাচ্ছে। বইমেলায় লেখকের সংখ্যা বাড়লেও মানসম্মত বই না হলে পাঠক বাড়বে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন