কিশোর সবুজ (১৪) রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার বস্তিতে মা-বাবার সাথে থাকে। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় করে এর বড় অংশ উড়িয়ে দেয় গাঁজা সেবনে। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় দুপুরে ও সন্ধ্যায় সবুজের মতো অনেক কিশোর-কিশোরী গাঁজা সেবনের জন্য জড়ো হয়।
অন্যদিকে কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তিতে সন্ধ্যা হলেই ভিড় কমে বদলে যায় চিত্র। বেড়ে যায় ভাসমান মানুষের আনাগোনা। ভেসে আসে উৎকট গন্ধ। আর ভাসমান মানুষদের কাছাকাছি ঘুরতে দেখা যায় উঠতি বয়সের গাঁজা বিক্রেতাদের। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ‘মামা লাগবে’ এই সঙ্কেতই যথেষ্ঠ? কেউ চটপট কিনে দ্রুত কেটে পড়ে।
একই অবস্থা রাজধানীর তিন শতাধিক গাঁজা বিক্রির স্পটে। এসব স্পটে সক্রিয় হাজারের বেশি মাদক বিক্রেতা। উঠতি বয়সি কিশোর-যুবক বা শ্রমজীবীরাই এদের প্রধান টার্গেট। কেউ কেউ এমন বেপরোয়া যে, ফুটপাথে বসেই গাঁজা সেবন করে। আর পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে হাঁটতে হয়। এতে বেশি বেকায়দায় পড়েন নারী ও শিশুরা।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর ২০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই গাঁজা সেবনে আসক্ত। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলেও দুপুর, সন্ধ্যা ও গভীর রাতে গ্রুপ বেধে গাঁজা সেবন করার দৃশ্য চোখে পড়ে। আবার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন করেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাঁজা সেবনের কারণে মানসিক ও শারীরিক সব ধরনের ক্ষতি হয়। সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। গাঁজা সেবনকারীরা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়। কখনো অতি আনন্দে আত্মহারা, আবার কখনো মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। অনেক সময় কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। অর্থহীন কথাবার্তা বলা, হাত-পা কাঁপা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়।
গাঁজা সেবনকারীরা প্রথমদিকে খাওয়া-দাওয়া বেশি করলেও ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি একেবারে কমে যায়। রক্তচাপ কমে বুক ধড়ফড় করে। সবকিছু থেকে আনন্দ হারায়। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ঘুমের নিয়ম বলে তাদের কিছু থাকে না। মানসম্মান ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে অন্যকে আঘাত করে। অনেক সময় আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। বিনা কারণে অন্যকে সন্দেহ করে। স্বাস্থ্য ভাঙতে ভাঙতে দুর্বল হয়ে পড়ে। হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে যৌনশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, মৎস্য ভবন মোড়, কাকরাইল মোড় হয়ে রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই গাঁজার উৎকট গন্ধ নাকে আসে। আশপাশেই পাওয়া যায় বিক্রেতাদের। কমলাপুর বিশ্বাস টাওয়ারের সামনে মতিঝিল, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ীর মধ্যে গাঁজা বিক্রির বড় স্পট। একইভাবে, খিলগাঁও রেলগেট, মানিকনগর ওয়াসা রোড ব্রিজ, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি, খিলগাঁও জোড় পুকুরের মাঠের পাশে, মৌচাক, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যেই গাঁজা বিক্রি হয়। সকাল হলেই প্রায় ৪ ঘণ্টার জন্য এসব স্থানে শুরু হয় গাঁজা কেনাবেচা। আবার বিকাল থেকে চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
জানা গেছে, এলাকায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে নারীরা বেশি জড়িত। মাদক ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে বয়সের ভিন্নতা। সকালের ক্রেতা সাধারণত ত্রিশোর্ধ্বরা আর বিকালের ক্রেতাদের অধিকাংশই ছাত্র-যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে।
তথ্য মতে, এসব স্থানে ১০০ টাকায় পাওয়া যায় গাঁজার পোটলা (কাগজে মোড়ানো)। এরপর পরিমাণ বুঝে ধাপে ধাপে দর বাড়তে থাকে। তবে ১০০ টাকার ক্রেতাই বেশি। শ্রমিক ও উঠতি বয়সি কিশোর তরুণরাই দুই-একবার সেবনের জন্য পোটলা সংগ্রহ করে। ২৫ গ্রাম গাঁজার জন্য খরচ করতে হয় এক হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। গাঁজা ক্রেতা-বিক্রেতাদের লেনদেনের ধরণও আলাদা। রিকশা, মোটরবাইক বা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা চলন্ত অবস্থায় সংগ্রহ করেন এই মাদক। তারা টাকা হাতে রাখে অন্যদিকে বিক্রেতা রেডি রাখে পোটলা। ফলে সেকেন্ডের মধ্যেই হাত বদল হয় গাঁজার পোটলা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশেই গাঁজাসেবীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। রাজধানীর অনেক ছাত্র-ছাত্রীও গাঁজা সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। গাঁজা ও অন্যান্য মাদক বিক্রির সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং মাদক প্রতিরোধে সক্রিয় রয়েছে ডিবিসহ ডিএমপির সকল পুলিশ।
হোম ডেলিভারিতে গাঁজা বিক্রি : আবার হোম ডেলিভারির মাধ্যমেও গাঁজা বিক্রির তথ্য মিলেছে। গাঁজা বিক্রেতারা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে এই ভয়ঙ্কর মাদক। এই ক্ষেত্রে মূল দামের সাথে ক্রেতাকে দিতে হয় সার্ভিস চার্জ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, গাঁজার হোম ডেলিভারি শুরু হয়েছে লকডাউনের সময় থেকে। তখন বিক্রেতা বাইকে করে বাসায় বাসায় গাঁজা পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমানেও এই পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন হোম ডেলিভারির ব্যবসা কিছুটা কমেছে।
মগবজারের ব্যবসায়ী আবদুল হালিম বলেন, কাজ শেষ করে বের হতে রাত হয়। যানজটের কারণে প্রায়ই কারওয়ানবাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হয়। এই পথ যেতেই গাঁজার উৎকট গন্ধে অস্বস্তিতে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই বাটা শোরুমের পাশের ফুটপাত এবং তেজগাঁও বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে ওভার ব্রিজের নিচ থেকে এই গন্ধ ভেসে আসে। কখনো কখনো গাঁজা কেনার অফারও পাই। তিনি বলেন, ঢাকার বাতাস তো এমনিতেই বিষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাঁজার গন্ধ। সবমিলে রাস্তায় চলা দায় হয়ে পড়েছে।
গত ২৯ মে বিকেলে একটি পাঠাও মোটরসাইকেল আটক করে অভিনব মাদকদ্রব্য ও গাঁজা উদ্ধারসহ মোটরসাইকেল আরোহী জুবায়ের হোসেন-কে আটক করা হয়। গুলশান থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যগুলো গুলশানের একটি বাসায় ডেলিভারী দিতে যাচ্ছে। জুবায়ের পুলিশকে আরও জানায়, সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এসব অভিনব মাদকদ্রব্য সরবরাহ করে। পরবর্তীতে তার দেয়া তথ্য মতে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে গাঁজা দিয়ে তৈরি মিল্কশেক, গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের চকলেট ১০৭টি ফোন ও ল্যাপটপ উদ্ধারসহ আরও দুই মাদক বিক্রেতাকে আটক করে পুলিশ।
ডিএমপির গুলশান জোনের ডিসি মো. আসাদুজ্জামান জানান, আটক আসামিদের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও গাজাসহ মোট ৭ কেজি মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, গ্রেফতারকৃত আসামিরা অনলাইনে ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে কানাডিয়ান ও আফ্রিকান মাদক ব্যবসায়ীদের তৈরি বিভিন্ন ইউটিউভ ভিডিও দেখে দেশীয় পদ্ধতিতে গাঁজা দিয়ে কেক, চকলেট, মিল্কসেক তৈরি করত। তারা ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমেই সেগুলো রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিক্রি করে আসছিলো। তারা ৫ কেজি গাজার নির্যাস দিয়ে ১ কেজি চকলেট তৈরি করত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন