বাংলাদেশে প্রতি বছরই দ্রব্যমূল্য হুহু করে বেড়ে চলেছে। এমন কোনো বছর নাই যে বছর পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে না। আর, একবার বাড়লে সেটি আর কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বিগত ৫১ বছরে একটি পণ্যের নামও উল্লেখ করা যাবেনা, যেটার দাম একবার বেড়েছে এবং পরবর্তীতে কমেছে। বাংলাদেশে সব জিনিসের দামই বেড়েছে। কিন্তু একটি মাত্র বস্তুর দাম কমেছে। আর সেটি হলো মানুষের জীবন। বিশেষ করে অসহায় এবং দরিদ্র মানুষদের জীবন। একজন-দুইজন নয়, শত শত মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। এসব মৃত্যু ঘটে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনায়। আর দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই মানুষের সৃষ্টি। আমরা একথা বলছি না যে মানুষ ইচ্ছা করে এসব দুর্ঘটনা ঘটায়। কিন্তু দেখা যায়, কর্তব্যে গাফিলতি বা নিয়মকানুনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ২০/২৫ জন থেকে শুরু করে ১০০/১৫০ জন মানুষেরও মৃত্যু ঘটে। এতগুলো আদম সন্তান মানুষের গাফিলতি বা ক্ষমতার দাপটের কারণে অকালে ঝরে যাওয়ার পরে এসব মৃত্যুর কোনো তদন্ত হয় না। তদন্ত হলেও সেই তদন্ত রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখে না। দুই একটি ক্ষেত্রে রিপোর্টের অংশ বিশেষ হঠাৎ করে ফাঁস হয়ে গেলেও কোনোদিন ঐসব মৃত্যুর বিচার হয় না। কোনো ক্ষেত্রে বিচার হলেও পালের গোদারা আড়ালেই থেকে যায়।
এসব কথা আজ বলতে হচ্ছে সীতাকুণ্ডে অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং সেই অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাব মোতাবেক ৪৯ জন অসহায় মানুষের করুণ এবং ভয়াবহ মৃত্যুর কথা স্মরণ করে। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চলতি মাসের ৪ তারিখে। এই অগ্নিকাণ্ডে শুধুমাত্র ৪৯ জন মানুষই মৃত্যুর মুখে পতিত হন নাই, অন্তত ৪০০ মানুষ আহত হয়েছেন। একের পর এক কন্টেইনার ডিপোর বিষ্ফোরণে প্রায় ৪ মাইল রেডিয়াস জুড়ে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। যারা আহত হয়েছেন তাদের অনেকে হারিয়েছেন তাদের পা, চোখ, হাত। বিষ্ফোরণের প্রকট শব্দে অনেকের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। শ্বাস তন্ত্রের প্রদাহ, শ্বাস কষ্ট এবং অনেকের চর্ম রোগ দেখা দিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রথমে যেটা বলেছিলেন এখন সেটা সকলেই বলছেন। তার বলছেন যে এই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাসায়নিক থাকার কারণে এত বড় বিষ্ফোরণ ঘটেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো বিষ্ফোরণের কারণে নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড তাদের শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণেই তাদের মৃত্যু ঘটে।
এ সম্পর্কে আরো কিছু বলার আগে আসুন, আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০১২ সালে আশুলিয়া তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে মারা যান ১১১ জন পোশাককর্মী। সেই ঘটনার মূল আসামী ছিলেন কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেলোয়ার হোসেন। আজ দীর্ঘ ১০ বছর পার হয়ে গেছে। তখন অনেক বিদগ্ধজন বলেছিলেন, এটি কোনো দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। কারণ কারখানা কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণেই ঐ অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং শতাধিক মানুষ মারা যান। আজও এই মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। বরং ঐ দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা উত্তর আওয়ামী মৎসজীবি লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। তাই অনেকে অশংকা করছেন, একই পরিণতি যদি বিএম কন্টেইনারে বিষ্ফোরণের ক্ষেত্রেও ঘটে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
॥দুই॥
জাতীয় সংসদে বিএনপি সদস্য রুমিন ফারহানা বলেছেন এবং আরও কোনো কোনো গণমাধ্যমে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, বিএম কন্টেইনার ডিপোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তার বিলক্ষণ জানার কথা যে, এই কন্টেইনার ডিপোতে কোনো রাসয়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখা সম্পূর্ণ বেআইনী। সেই ডিপোতে তিনি বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ অর্থাৎ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মজুদ করেছিলেন। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেওয়া তো দূরের কথা, তিনি তাদের সাথে আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু তাই নয়, তার আরেকটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এই যে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন সেখানে অগ্নি নির্বাপনের জন্য যান তখন তিনি তাদের বলেননি যে, এখানে কোনো বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুদ আছে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন, মুজিবুর রহমানই যেখানে মামলার প্রধান আসামী হওয়ার কথা সেখানে পুলিশের মামলায় আসামীদের তালিকা থেকে মুজিবুর রহমানকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ বলেন, রূপগঞ্জে হাশিম ফুড কারখানায় যে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল সেখানে কারখানার মালিককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সীতাকুণ্ডের ঘটনায় মালিককে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তাকে আসামীও করা হয়নি। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদের মতে, হাশিম ফুড কারখানার মালিক সরকারপন্থী ছিলেন না। তার মতে, যেখানে মালিককেই প্রধান আসামী করার কথা সেখানে সীতাকুণ্ড কন্টেইনার ডিপোর মালিককে বাঁচিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, বিএম কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে মালিক পক্ষকে বাদ দিয়ে ৮ ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। সীতাকুণ্ড থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন যে, ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড এবং বিষ্ফোরণে কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে কারণ হিসাবে আমরা উল্লেখ করেছি। অন্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন যে, আমরা যে মামলাটি করেছি সেটি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেই করা হয়েছে।
সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হয়েছে। এরমধ্যে কিছু বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবীও তাদের মতামত দিয়েছেন। এক শ্রেণির আইনজীবী বলেন যে, যেভাবে মামলাটি সাজানো হয়েছে তার ফলে মালিক পক্ষকে রক্ষা করার একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা রয়েছে। এ ব্যাপারে তারা আইনের কতকগুলি ধারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন যে, মামলাটি করা হয়েছে দন্ডবিধির ৩৩৭, ৩৩৮, ৩০৪(ক) এবং ৪২৭ ধারায়। যাদেরকে আসামী করা উচিৎ ছিল তাদেরকে আসামী না করে মামলাটি দুই দিক দিয়ে দুর্বল করা হয়েছে। যে চারটি ধারা ওপরে উল্লেখ করা হলো এই চারটি ধারাতেই রয়েছে অনিচ্ছাকৃত অপরাধ। কিন্তু মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে যে, কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ প্রকৃত তথ্য গোপন করায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা গেছেন। মালিকপক্ষকে দায়ী করে যদি মামলা করা হতো তাহলে সেই মামলা হতো ৩০২ ধারায়। সেটি না করে উল্লেখিত চারটি ধারায় করা হলো কেন? পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যাই বলুন না কেন, আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে ৩০২ ধারা এখানে আনা হয়নি।
৩০২ ধারায় মামলা হওয়ার দুইটি শর্ত আছে। একটি হলো জ্ঞাত সারে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে (নলেজ অ্যান্ড ইন্টেনশন)। এই দুটি শর্তের যে কোনো একটি শর্তের অধীনে মামলা করলেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসতো। শুধু সরাসরি হত্যা করলেই হত্যাকাণ্ডের অপরাধ হয় না। মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এবং অতঃপর সেই পরিস্থিতির কারণে মৃত্যু হওয়াকেও হত্যাকাণ্ড বলা হয়। আলোচ্য ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের প্রথম অপরাধ হলো দাহ্য পদার্থ রাখা। দ্বিতীয় অপরাধ হলো, সেটি কাউকে না জানানো এবং ঐ ধরণের বিষ্ফোরোন্মুখ পরিস্থিেিত শ্রমিকদেরকে কাজ করতে দেওয়া। তৃতীয় এবং বড় অপরাধ হলো ফায়ার ফাইটাররা যখন আগুন নেভাতে যান তখনও তাদের বলা হয়নি যে এখানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আছে। যদি সেটি ফাইটারদের বলা হতো তাহলে ৯ জন অগ্নি নির্বাপক কর্মীর প্রাণ যেত না।
॥তিন॥
সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড এবং তার ফলে ৪৯ ব্যক্তির প্রাণহানি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রকম মতামত দিয়েছে। আমরা সেই সব মতামতের মধ্যে যাচ্ছি না। আমাদের মূল বিষয় হলো, মানুষের অমূল্য জীবন। কেন এতগুলো মানুষের জীবন হানি ঘটলো তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পর যারাই দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের আইন মোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এক্ষেত্রে তদন্তের আগেই এমন কিছু কথা বলা হচ্ছে, যার ফলে তদন্ত প্রভাবিত হয়। বলা হচ্ছে যে, এক্ষেত্রে কোনো নাশকতা হয়েছে কিনা সেটিও খুঁজে দেখতে হবে। এই যে তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সেটিকে যদি কেউ উদ্দেশ্যমূলক বলেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ ৫/৬টি তদন্ত টিম নাকি এখানে কাজ করছে। এতগুলো তদন্ত টিমের কারো না কারো তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসা উচিৎ। যদি নাশকতা থেকে থাকে তাহলে সেটাও বেরিয়ে আসার কথা। নাহলে কিসের এত তদন্ত? কিসের এতগুলো টিম?
এসব আশঙ্কার কথা অগ্রিম প্রকাশ করলে মালিক পক্ষকে আড়াল করার একটি সুযোগ দেওয়া হয়। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, হাশিম ফুড প্রোডাক্টসে আগুন লাগলো, আর সাথে সাথেই তার মালিককে গ্রেফতার করা হলো। আর এক্ষেত্রে অর্থাৎ বিএম ডিপোতে এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটার পরেও মালিকের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি কেন? উল্টো, মালিককেও বলতে শোনা যাচ্ছে যে, এই অগ্নিকাণ্ডে বাইরের কারো হাত থাকতেও পারে। তাকে তো তৎক্ষণাৎ ধরা উচিৎ ছিল এবং বলা উচিৎ ছিল যে, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাহলে এত নড়বড়ে কেন যে সেগুলোর ফাঁক ফোকর দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করা সুযোগ থেকে যায়?
আমাদের শেষ কথা হলো, ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক, অতীতে এই ধরণের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং কয়েকশত আদম সন্তান অকাল মৃত্যু বরণ করেছে। এর আগে আমরা হাশিম ফুড প্রোডাক্টস এবং তাজরিন ফ্যাশনের কথা উল্লেখ করেছি। সেই সাথে যুক্ত করতে চাই রানা প্লাজার ঘটনা। কোনটারই কি নিষ্পত্তি হয়েছে? চকবাজারের চুড়িহাট্টা থেকে কি এখনও সব কেমিক্যাল সরানো হয়েছে? এই লেখার আগের দিনই চুড়িহাট্টার এক বাসিন্দা জানালেন যে, একটু ভেতরে ঢুকলেই অসংখ্য কেমিক্যালের কন্টেইনার দেখা যাচ্ছে। আমাদের কথা, মানুষের জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। সেটি নিয়ে আর হেলাফেলা নয়।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন