হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ বিধান। হজের মাধ্যমে মহান রবের সান্নিধ্য লাভ হয়। লাব্বাইক ধ্বনিতে রবের দরবারে হাজিরা দিয়ে সকল গুনাহের জন্য তাওবা করে রবের পবিত্র ঘর জেয়ারতের পর প্রিয় নবীজির রওজা মোবারক জেয়ারত করে রবের প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে হজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ইসলামের ভীত পাঁচটি জিনিসের উপর স্থাপিত আছে। (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (২) নামায কায়েম করা (৩) জাকাত প্রদান করা (৪) বায়তুল্লাহর হজ্জ করা এবং (৫) মাহে রমযানের রোযা পালন করা। (রিয়াদুস সালেহিন-১২৭৯)।
পবিত্র কুরআনে মহান রব এই নির্দেশই দিয়েছেন। রব্বে কারীম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ এবং ওমরা পূর্ণ কর। (সুরা বাকারা : ১৯৬) অন্য আয়াতে রব্বে কারীম ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের (কাবাঘর) হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। হজ একটি আর্থিক এবং শারীরিক ইবাদত। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এতে কষ্ট বেশি তাই এতে সওয়াবও বেশি। হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আকরা ইবনু হাবিস (রা.) নবী করীম (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ প্রতি বছরই ফরয, নাকি মাত্র একবার? তিনি বললেন, জীবনে বরং একবারই, তবে কেউ অধিক করলে সেটা তার জন্য নফল। (আবু দাউদ : ১৭২১)।
হজের ফরজ তিনটি। যথা- ১) ইহরাম বাঁধা ২) আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ৩) তাওয়াফে জেয়ারত করা। হজের ওয়াজিব পাঁচটি। যথা- ১) মুযদালিফায় অবস্থান করা ২) সাফা-মারওয়ায় সায়ী করা ৩) জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা ৪) বিদায়ী তাওয়াফ করা ৫) মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা। হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। আরাফার দিনের ফজিলত বর্ণনায় হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আয়িশা (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আরাফার দিবসের তুলনায় এমন কোন দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক লোককে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের সামনে গৌরব করেন এবং বলেন, তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (তারা কী চায়)? (মুসলিম : ৩১৭৯)।
কবুল হজের পুরস্কার বর্ণনায় হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, একটি উমরা পরবর্তী উমরা পর্যন্ত মাঝখানের গুনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ এবং ত্রুটিমুক্ত (অথবা আল্লাহর নিকট গৃহীত) হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া এর কিছু নয়। (মুসলিম : ৩১৮০) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ (কাবা.) ঘরে (হজের উদ্দেশ্যে) আসে, অতঃপর অশ্লীল আচরণও করে না এবং দুষ্কর্মও করে না সে এমন (নিষ্পাপ) ভাবে প্রত্যাবর্তন করে যে তার জননী তাকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) প্রসব করেছেন। (মুসলিম : ৩১৮২)। হাজী তথা হজ আদায়কারীকে রাসূল (সা.) আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্র প্রতিনিধি তিন ব্যক্তি, গাযী (মুজাহিদ), হাজী ও উমরা আদায়কারী। (নাসায়ী : ২৬২৫)।
হজ তিন প্রকার। যথা- ১) হজ্জে ইফরাদ ২) হজ্জে তামাত্তু ৩) হজ্জে কিরান। ইমাম আবু হানীফা (রহ) এই তিন প্রকারের মধ্যে হজ্জে কিরানকে সর্বোত্তম বলেছেন। রাসূল করীম (সা.) এই হজ্জে কিরানের ফজিলত বর্ণনায় ইরশাদ করেছেন, হযরত আমর ইবন দীনার (রহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা হজ ও উমরা পরস্পর পালন করবে, কেননা এ দু’টি অভাব অনটন ও পাপকে দূর করে দেয় যেমন কামারের হাপর লোহার মরিচা দূর করে থাকে। (নাসায়ী : ২৬৩০) হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা হজ ও উমরা পরপর একত্রে আদায় করো। কেননা, এ হজ ও উমরা দারিদ্র্য ও গুনাহ দূর করে দেয়, লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা যেমনভাবে হাপরের আগুনে দূর হয়। একটি কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। (তিরমিজি : ৮১০)।
হাজীদের জন্য সাতটি মীকাত রয়েছে। আর মীকাত হলো ঐ স্থান যা ইহরাম ছাড়া অতিক্রম করা বৈধ নয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মীকাত হলো ইয়ালামলাম। মীকাত সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনাবাসীদের জন্য যুলহুলায়ফা, সিরিয়া ও মিসরবাসীদের জন্য জুহফা, ইরাকবাসীগণ জন্য যাতু ইরক, নজদবাসীদের জন্য কারন এবং ইয়ামানবাসীদের জন্য ইয়ালামলামকে মীকাত নির্ধারণ করেছেন। (নাসায়ী : ২৬৫৬)। হজের মাধ্যমে বান্দা মহান রবের দরবারে হাজিরা দিয়ে বলে, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নেমাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকালাক।’ মহান রবের নৈকট্যলাভের অপার সুযোগ হলো হজ। রব্বে কারীমের দরবারে হাজিরা দিয়ে, রাসূলে আকরাম (সা.) এর রওজা জেয়ারতের মধ্য দিয়ে বান্দার অন্তরে আল্লাহর মহব্বত এবং রাসূলের মহব্বত সৃষ্টি হয়। আর রাসূল (সা.) বলেছেন, কবুল হজের পুরস্কার হলো জান্নাত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন