চান্দ্রবর্ষের বারোটি মাসের মধ্যে সব মাস আল্লাহ্ তায়ালার কাছে সমান মর্যাদার অধিকারী হলেও চারটি মাসের বিশেষ মর্যাদা ও ফযিলত রয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ চার মাসের অন্যতম জিলহজ মাস অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী। এ মাসটি পবিত্র কুরআনুল কারিমে বর্ণিত বছরের চারটি সম্মানিত মাসের একটি। মহান আল্লাহ্ কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্র বিধান ও গণনায় মাস ১২টি- আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চার মাস সম্মানিত’ (সূরা তাওবা: ৩৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ওই মাসগুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মুর্হরম ও রজব।
প্রতিবছর এ পবিত্র মাসের দশ তারিখে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ্ মহান আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা ও নবি হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং অনুপম ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে থাকেন। মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও তাঁর একনিষ্ঠ দাসত্বের নিদর্শনস্বরূপ বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ প্রতি বছর এ মাসে হজব্রত পালন ও প্রিয় পশু কুরবানি করে থাকে।
হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুরো পরিবারের নযিরবিহীন কুরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। হযরত ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার মহান আল্লাহ্র প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলোকে আল্লাহ্ তায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আর এই হজ ও কুরবানি সম্পন্ন হয় পবিত্র জিলহজ মাসে। যার ফলে ইসলামে জিলহজ মাসের গুরুত্ব অধিক।
মাস হিসেবে পবিত্র রমযানুল করিম আর দিন হিসেবে পবিত্র জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ। পবিত্র কুরআনুল করিমের সূরা হজের ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহর নামের স্মরণ করে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।’ বিশিষ্ট তাফসিরকার হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, নির্দিষ্ট দিন বলতে এখানে জিলহজ মাসের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে (ইবনে কাসির)। তাছাড়া সূরা ফাজরের ১-২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘শপথ প্রভাতের। শপথ দশ রাতের। এখানে যে ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা হলো জিলহজের প্রথম ১০ রাত। (তাফসিরে ইবনে কাসির, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৫৩৫)। ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ ও ইকরামা (রহ.) Ñএর মতে, ১০ রাত বলতে জিলহজের ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ মাসের ১০ দিনের মর্যাদা প্রমাণিত।
এ মাসের নবম দিন ও রাত আল্লাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই দিনটি আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন। আর রাতটি হলো মুযদালিফায় অবস্থানের রাত। বিশেষ করে ৯ জিলহজ রোযা আদায়ের ব্যাপারে প্রিয় মহানবি (স.) সবচেয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন। হযরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আরাফার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এদিনের রোযা পালনকারীকে গত এক বছর এবং আগত এক বছরের গুণাহ্সমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৪০)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহ্র কাছে অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়। প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোযার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল ক্বদরের ইবাদতের মতো’ (তিরমিযি: ৭৫৮, ১ম খণ্ড)।
নবি (স.) বলেছেন, ‘যে আরাফার দিনে রোযা রাখলো অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালা তার এক বছর পূর্বের এবং এক বছর পরের তথা দুই বছরের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসলিম)। তবে যারা হজ আদায়ে ওইদিন আরাফায় অবস্থান করবেন, তাদের জন্য এই বিধান কার্যকরি নয়। কেননা মহানবি (স.) আরাফাত ময়দানে অবস্থানকালে রোযা পালন করেননি। আরাফায় যারা অবস্থান করবেন, তারা যদি রোযা রাখেন, তাহলে হয়তো অন্যান্য যে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত-বন্দেগি রয়েছে, তা সঠিকভাবে পালন করতে তাদের কষ্ট হতে পারে। তাই আরাফায় যারা অবস্থান করবেন, তাদের জন্য রোযা না রাখাটাই উত্তম।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (স.) বলেছেন, এই ১০ দিনের আমল অপেক্ষা অন্য দিনের আমল প্রিয় নয়। (সহিহ্ বুখারি: ৯২৬)
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফযিলত সম্পর্কে মহানবি (স.) আরো বলেন, এমন কোনো দিন নেই যে দিনগুলোতে ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের ইবাদত থেকে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এই ১০ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়? রাসূল (স.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এই ১০ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়; তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরে এলো না।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৩৮)
জিলহজের প্রথম দশকের প্রত্যেক দিনের রোযা এক বছরের রোযার সমতুল্য। আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য (তিরমিযি)।
জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোযা পালন করা, রাতে বেশি বেশি নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ্-তাহলিল, দুআ-দরুদ, তওবা, ইস্তিগফার ইত্যাদি ইবাদত করা আল্লাহ্র কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল জিলহজের প্রথম ১০ দিনের। হযরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (স.) বলেছেন, আল্লাহ্র কাছে কোনো দিনই প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ ১০ দিনের তুলনায়। সুতরাং তোমরা তাতে (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) বেশি বেশি তাহ্লিল, তাক্বির ও তাহ্মিদ পাঠ করো’ (তাবারানি)।
জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে নিয়ে চুল, গোফ, নখ ও শরীরের অন্যান্য স্থানের লোম না কাটা। এ সম্পর্কে উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবি (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কুরবানির ইচ্ছে পোষণ করে, সে যতক্ষণ কুরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেনো চুল বা নখ না কাটে।’ (সহিহ্ মুসলিম: ৩৬৫৬)
জিলহজ মাসের আরাফা দিবসে হিজরতের দশম বছরে মহান আল্লাহ্ ইসলামের পূর্ণতা ঘোষণা করেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিনকে পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বিন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা: ৩)
আর এই জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামায থেকে নিয়ে ১৩ তারিখের আসরের নামায পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাযের পর তাক্বিরে তাশ্রিক (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) পড়া ওয়াজিব। নারী-পুরুষ সবার জন্য ফরজ নামাযের পর এই তাক্বিরে তাশ্রিক পাঠ করা কর্তব্য।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, জিলহজ মাসের বিশেষ ফযিলত ও মর্যাদার অংশীদার হওয়ার জন্য নির্ধারিত আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন