শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

২১ কর্মচারীর গ্রেড জালিয়াতি

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ১৬ গ্রেডে চাকরি করে ১৪ গ্রেডের বেতন আদায়

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০২২, ১২:০৫ এএম

মো. জহিরুল হক ১৯৮৩ সালের ৬ জুন সিভিল সার্জন নোয়াখালীর নিয়োগপত্রে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জাতীয় বেতন স্কেল-১৯৭৭ এর ৩০০-১২-৩৯৬-ইবি-১৮-৫৪০ টাকা স্কেলে নিম্নমান সহকারী (এলডি অ্যাসিসট্যান্ট) হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। প্রায় ৩ বছর ৩ মাস নিম্নমান সহকারী পদে চাকরি করার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক আদেশে তাকে নিয়োগ বিধি বহির্ভূতভাবে ও পদ সোপানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সমস্কেলে স্টোর সহকারী পদে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে বা সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর ডিপোতে (সিএমএসডি) বদলি করা হয়। নিয়োগবিধি ১৯৮৫ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতরের (সদর দফতর) সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ৭৮টি পদের মধ্যে স্টোর সহকারী পদটি না থাকায় মো. জহিরুল হক ওই নিয়োগবিধির ৪৪ ক্রমিকে সন্নিবেশিত স্টোর কিপার/স্টোর সহকারী পদে সিএমএসডিতে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দায়িত্ব পালনের সুবাদে নিম্নমান সহকারী (এলডিএ) মো. জহিরুল হক বনে যান স্টোর কিপার/স্টোর সহকারী।

এ পদে তিনি স্টোর কিপারের অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ৩১ বছর দায়িত্ব পালন করে তার ফিডার পদের (নিম্নমান সহকারী) বেতন স্কেলের ধারাবাহিকতায় ৩টি টাইমস্কেল পেয়ে ১৩ গ্রেডে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন। হঠাৎ ২০১৭ সালের মার্চে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১৯৯১ সালে অম/অবি/(বাস্ত)-৪/ইউ(জি)-৩/৮০(অংশ)-৩৯ স্মারকমূলে জারিকৃত এক আদেশ বলে তিনি সিএজি থেকে ১১ গ্রেডে বেতন অনুমোদন করিয়ে নেন এবং সিএমএসডিতে যোগদানের তারিখ হতে স্টোর কিপারের ১৪ গ্রেডে বেতন-ভাতা সুবিধা গ্রহণ করেন। এ সুবিধার আওতায় তিনি সিএমএসডিতে যোগদানের তারিখ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৭ লাখ টাকা বকেয়া বেতন-ভাতা নেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে আদেশবলে মো. জহিরুল হক স্কেল জালিয়াতির মাধ্যমে স্টোর কিপারের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন ওই আদেশের (খ)-তে উল্লেখ আছে ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং উহার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত সকল স্টোর কিপারের পূর্বের সকল বেতন স্কেল নির্বিশেষে সংশোধিত বেতন স্কেল ৬-২-৮৫ তারিখের আদেশে প্রদর্শিত ১-৭-৭৭ ইং তারিখ থেকে ৩৭০-৭৪৫/- টাকায় নির্ধারণ করা হইল।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশের মর্মানুযায়ী মো. জহিরুল হক নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতি প্রাপ্ত স্টোর কিপার নন। তিনি ১৬ গ্রেডের নিম্নমান সহকারী (এলডি অ্যাসিসট্যান্ট) পদে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। চাকরিতে যোগদানের পর তিনি কোনো পদোন্নতিও পাননি।

শুধু মো. জহিরুল হকই নন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশবলে স্কেল জালিয়াতির মাধ্যমে স্টোর কিপারের ১৪ গ্রেডে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছে সিএমএসডির আরো ২০ জন স্টোর সহকারী। এই ২০ জন স্টোর সহকারী ১-৭-১৯৭৭ সাল বা তার পর থেকে যে যখন সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছে তখন থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজস্ব বাজেটের প্রায় কোটি টাকা বকেয়া বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছে। অবৈধ আর্থিক সুবিধাভোগী এই ২১ জনের মধ্যে ১২ জনকে স্বাস্থ্য অধিদফতর ১৯৯৩ সালে ১২০০-৭*৬০-১৬২০-ইবি-১১* ৬৫-২৩২৫ টাকা স্কেলে, ৫ জনকে ২০০৪ সালে ১৮৭৫-৯০*৭-২৫০৫-ইবি-১০০*১১-৩৬০৫ টাকা স্কেলে স্টোর সহকারী পদে নিয়োগ দিয়ে সিএমএসডিতে কাজ করার জন্য বহাল করে। বাকি ৪ জনের ৩ জন ১৯৯৩ সালের পূর্বে টেম্পোরারি কুলি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তীতে বিধি বহির্ভূতভাবে স্টোর সহকারী পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অপরজন নোয়াখালীর সেনবাগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিম্নমান সহকারী পদে যোগদানকারী মো. জহিরুল হক।

এদের মধ্যে স্টোর কিপারের স্কেলে মোটা অঙ্কের অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে ইতোমধ্যে টেম্পোরারি কুলি থেকে বিধি বহির্ভূতভাবে স্টোর সহকারী পদে পদোন্নতি পাওয়া মো. হারুন-উর-রশিদ, মো. রুহুল আমিন, মোহাম্মদ আলী খানসহ স্টোর সহকারী আব্দুর রহিম বাবুল ও মো. নুরুল ইসলাম পেনশনে চলে গেছেন। বর্তমানে ১৯৯৩ সাল ও ২০০৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৫ জন স্টোর সহকারী সিএমএসডিতে স্টোর কিপার/স্টোর সহকারী পদে কর্মরত আছেন। এরা হলেনÑ মো. দিদারুল আলম, আবু আহমেদ আহসান হাবিব, আবু কালাম আজাদ, খান নাজমে এহসান, কে এম ফরিদুল ইসলাম, মো. জসিম উদ্দিন, মো. আবুল কাশেম, রোজিনা আক্তার, মো. আশ্রাব উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম ভূইয়া, মাজহারুল ইসলাম ভুইয়া, মোহাম্মদ ইউসুফ ফকির এবং মমিনা আক্তার।

২০১৮ সালে এসআর নম্বর ৯১-আইন দ্বারা দ্য বাংলাদেশ হেলথ্ সার্ভিসেস (নন-মেডিক্যাল অফিসার্স অ্যান্ড এম্পøয়িজ রিক্রুটমেন্ট) রুলস্, ১৯৮৫ বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিক্যাল কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০১৮ বহাল করা হয়। এই বিধিমালার ৬৪ ক্রমিকে স্টোর কিপার/স্টোর সহকারী পদটিকে ১৬-গ্রেডের পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণযোগ্য একটি পদ। এই পদটি ১৯৮৫ সালের বাংলাদেশ হেলথ্ সার্ভিসেস (নন-মেডিক্যাল অফিসার্স অ্যান্ড এম্পøয়িজ রিক্রুটমেন্ট) রুলস্-এর ৪৪ ক্রমিকে সন্নিবেশিত পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অথচ এই ১৬ গ্রেডের পদটিকে ২০১৭ সালে ১৪ গ্রেডের (৩৭০-৭৪৫) স্টোর কিপার পদ হিসেবে পরিগনিত করে সিএমএসডির তৎকালীন সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. গঙ্গাগোবিন্দ পাল সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সাথে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেনে স্কেল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পারভেজ কবীরকে বুঝিয়ে ২১ জন স্টোর সহকারীকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা প্রদান করেন।

প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২৭-১১-১৯৯১ ইং তারিখের অম/অবি/(বাস্ত)-৪/ইউ(জি)-৩/৮০(অংশ)-৩৯ স্মারকমূলে জারিকৃত পত্রের অনুকূলে এজিবি, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-এর অডিটর মো. সাইফুজ্জামান, এসএএস সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ নূর আলম মিয়া, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম সিএমএসডির ক্যাশ সরকারের সাথে দফারফা করে ৩৭০-৭৪৫ টাকা স্কেলের অবৈধ আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। বর্তমানে এই স্টোর সহকারীরা স্কেল জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য গ্রেডের ২ গ্রেড উপরে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রতি মাসে বেতন-ভাতার সাথে গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা বেশি উত্তোলন করছে। এ খাতে প্রতি মাসে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে রাজস্ব বাজেটের প্রায় লক্ষাধিক টাকা।

মূলত সিএমএসডিতে ‘স্টোর কিপার’ নামে কোনো পদ নেই। তবে স্টোর কিপার স্কেলে মোট ৮টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি পদ স্টোর কিপার/উচ্চমান সহকারী নামে, বাকি ২টি পদ উচ্চমান সহকারী নামে। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয় জারিকৃত স্বাস্থ্য অধিদফতরের (সদর দফতর) সংশোধিত সাংগঠনিক কাঠামোতে সিএমএসডির জন্য ৩০০-১২-৩৯৬-ইবি-১৮-৫৪০ টাকা স্কেলের ৩২টি স্টোর সহকারীর পদ রয়েছে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর এই মঞ্জুরিকৃত ৩২টি স্টোর সহকারীর অনুকূলেই সিএমএসডির জনবল নিয়োগ দেয়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সিএমএসডিতে স্টোর কিপার/স্টোর সহকারী পদে দায়িত্ব পালনকারী স্টোর সহকারী মো. নূরুল ইসলাম স্টোর কিপারের অবৈধ আর্থিক সুবিধা ভোগ করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার পেনশন, লাম্পগ্রান্ট প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সিএমএসডি থেকে প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। এই পেনশনের কেইসটি সিএজি নিষ্পত্তি না করে তার কার্যালয়ের ১০-১১-২০২১ তারিখের ৫৬০ মূলে ৪ দফা উত্তর চেয়ে উপ-পরিচালক (সিএমএসডি) বরাবর ফিরতি চিঠি দেন। এর মধ্যে দফা ৩-এ কোন আদেশবলে সংশোধিত বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে তার কপি চাওয়া হয়েছে। বিগত ৭ মাসেও সিএমএসডি সিএজির ওই ফিরতি চিঠির উত্তর দিতে পারেনি। স্কেল জালিয়াতির উক্ত আর্থিক অনিয়মকে বহাল রেখেই সিএমএসডির বর্তমান পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার ২০০৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫ জন স্টোর সহকারীকে ১৪ গ্রেডের স্থলে ১২ গ্রেডের স্কেল সুবিধা দিয়ে দ্বিতীয় উচ্চতর স্কেল মঞ্জুর করেছেন। এ বিষয়ে একাধিকবার মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকারের মোবাইলে যোগাযোগ করলে তাঁর মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Robiul Islam ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, ৩:০৯ পিএম says : 0
এটা একটা ভালো মানের সাংবাদিকের লেখা হতে পারে না। সাংবাদিক হিসেবে লেখার যে মান থাকার কথা তা তার মধ্যে নেই কিংবা টাকার বিনিময়ে কারো লেখা ছাপানো হয়েছে। এধরনের সাংবাদিকেরা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন