রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের প্রতি জনগণ ও রাজনৈতিক দলের আস্থা ফেরাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কিভাবে সুষ্ঠু ও সকলের অংশগ্রহণমূলক করা যায় সে জন্য কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নতুন ইসি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে। তাদের এ সংলাপে আমন্ত্রিত দুই-তৃতীয়াংশ অংশ নেয়নি। শুরুতে শিক্ষাবিদদের সাথে অনুষ্ঠিত সংলাপে আমন্ত্রিত ৩০ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১৩ জন। সে হিসাবে শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের আস্থা অর্জনে শুরুতেই হোঁচট খায় ইসি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের অভিমত, গত নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ নুরুল হুদা কমিশনের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে যে ভোট হয়েছে তাতে মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। বরং অনেক জায়গায় ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের ভোটের প্রতি চরম অনীহা ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন সংলাপের মাধ্যমে পরামর্শ নিয়ে বিভিন্ন শেণিপেশার আস্থা অর্জনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাতেও ইসি সফল হতে পারেনি।
এরপর নির্বাচন কমিশনের সামনে আসে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ইসি তাদের সক্ষমতা প্রমাণের প্রথম সুযোগ পায়। প্রথম নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান কতটা শক্ত তা দেশবাসীর কাছে প্রমাণের বড় সুযোগ ছিল। সেই সাথে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের যথার্থতা প্রমাণেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতেই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেনি ইসি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান প্রমাণে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কুমিল্লায় একজন স্থানীয় সংসদ সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন সংসদস সদস্যকে এলাকা ত্যাগ করার কথা বললেও তিনি এলাকাতেই অবস্থান করেছেন। নির্বাচন কমিশনের চিঠিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সংসদ সদস্য দিব্যি তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আর নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ না করে উল্টো অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অত্যন্ত অসহায়ভাবে বলেছেন, একজন সংসদ সদস্যকে জোর করে এলাকা ছাড়া করার ক্ষমতা ইসির নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের পর তাদের সম্পর্কেও আগের দুটো নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ রকিব এবং হুদা কমিশনের মতোই মেরুদণ্ডহীন, আজ্ঞাবহ এমন ধারণাই জনমনে তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, নির্বাচন কমিশন আইনে বলা আছে, নির্বাচন চলাকালে প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। নির্বাচন কমিশনকে সকল প্রকার সহায্য-সহযোগিতা করবে। এখন এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসি যদি সক্ষম না হয় তাহলে তো সেই অতীতের মতোই নির্বাচন হবে। কুমিল্লা নির্বাচনে বর্তমান ইসি তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেনি এমনটাই দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা দীর্ঘদিন থেকে বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল ভোট চুরি করবে বা নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেবে। গত ১৬ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনানুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার সময় তৈরি হওয়া একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি প্রকাশ্যে আসার পর নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে বিরোধীদের তোলা আপত্তি আরো জোরালো হয়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে শুরুতে নির্বাচন কমিশনকে খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি। বরং প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা ইসির নেই। তবে গত ৭ মে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর ইভিএমের বিষয়টি আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন আলোচনায় আসে, তেমনি নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে তোড়জোর শুরু করে। তবে এ ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পর ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি আরো জোরালো হয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন আস্থা অর্জনের পাশাপাশি ইভিএম নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করে। গত ১৯ জুন থেকে ৩ পর্যায়ের এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিএনপিসহ আরো ১১টি রাজনৈতিক দল এই মতবিমিয়ে অংশ গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া বাকি ২৮টি দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মাত্র ৪টি দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নেয়। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বাকি ২৪টি দলও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরে। মোটকথা ৩৯টি দলের মধ্যে ৩৫টি দলই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাই ইভিএম ইস্যুতেও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে ইসি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তারপরও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে ইসি। অনেক রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকের ধারণা, ইভিএম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইসির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্লেষকদের অভিমত, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও আওয়ামী লীগের ইভিএম সমর্থনের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে তুলবে, যা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন