সুন্দরবনের খাল-নদীতে কীটনাশক ও বিষ দিয়ে মাছ শিকার প্রতিরোধে বন বিভাগের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। তারপরও বেপরোয়াভাবে চলছে এভাবে মাছ ও চিংড়ি শিকার। সরকারিভাবে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও গোপনে বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ ধরণের কর্মকাণ্ড তারা চালিয়ে যাচ্ছে। গত এক মাসে বিষ দিয়ে চিংড়ি ধরার অপরাধে ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে, মামলা হয়েছে ৩৯টি। উদ্ধার হয়েছে ১০টি নৌকা, বিপুল পরিমাণ কীটনাশক, জাল ও মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার রাত ২টার দিকে কাশিয়াবাদ স্টেশনের অধিনস্থ শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির টানাভারানী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৭০ কেজি চিংড়িসহ ১টি নৌকা আটক করে শাকবাড়িয় বন টহল ফাঁড়ির স্টাফরা। একই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে বজবজা টহল ফাঁড়ির সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ১টি নৌকা নিষিদ্ধ জাল, বরফ ও কীটনাশক উদ্ধার করে। অন্যদিকে খাশিটানা টহল ফাঁড়ির সদস্যরা একই রাত ১টার দিকে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ভারতীয় বিষসহ ১টি নৌকা বরফসহ মাছ ধরার সরঞ্জাম আটক করে। এর আগে গত ৩ জুলাই রাতে কাশিয়াবাদ স্টেশনের সদস্যরা ১০০ কেজি মাছসহ ১টি নৌকা আটক করে। ২ জুলাই দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের অধিনস্থ কাশিয়াবাদ স্টেশন ও তার আওতাধীন টহল ফাঁড়ির সদস্যরা বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৪০০ কেজি চিংড়ি জব্দ ও তিনটি নৌকা, হরিণ ধরার সরঞ্জাম ও ফাঁদসহ বরফ জব্দ করা হয়। গত ১ জুলাই রাতে কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কুলুখালীর ভারানী এলাকা থেকে ২৭০ কেজি বিষ প্রয়োগ করা চিংড়িসহ একটি নৌকা আটক করে। এছাড়া ওই রাতে খুলনা থেকে কয়রাগামী লঞ্চে অভিযান চালিয়ে ৬০ কেজি জেলি মিশ্রিত চিংড়ি আটক করা হয়। অন্যদিকে বজবজ বন টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমানের নেতৃত্বে একই রাতে খড়কুড়ি নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ ধরার ফাঁদ, চারটি চাকু বরফসহ একটি নৌকা আটক করা হয়। এ সময় বন বিভাগের অভিযান জানতে পেরে হরিণ শিকারিরা পালিয়ে যায়। গত ২ জুন রাত ১টার দিকে খাশিটানা বন টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে ছেড়ারমুখে অভিযান চালিয়ে একটি নৌকাসহ ৮৫ কেজি অবৈধ চিংড়ি জব্দ করা হয়। পরে তা কয়রা উপজেলা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে মাটিতে পুঁতে বিনষ্ট করা হয়েছে।
বনজীবিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারিভাবে মৎস আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় অনেকেই গোপনে মাছ শিকার করে সংসার চালাচ্ছে। তবে বিষ দিয়ে যারা মাছ ধরে তাদের সাথে সাধারণ জেলেদের কোনো সম্পর্ক নেই, তারা দুর্বৃত্ত।
এদিকে, সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গ্লোবাল খুলনার আহ্বায়ক শাহ মামুনুর রহমান তুহিন ও নেতৃবৃন্দ গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে খুব সামান্যই বর্তমানে টিকে আছে। হিরণ পয়েন্ট থেকে কাঠকাটা পর্যন্ত বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হয়। প্রতি রাতে ১০-১২ লাখ টাকার চিংড়ি বিষ দিয়ে মারা হয়। এখানে বড় ধরনের চক্র আছে। কারা এর সঙ্গে জড়িত এ তথ্য উদ্ঘাটন করে কঠোরভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
কয়রা রিপোটার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সুবজ আন্দোলন, কয়রা মানব কল্যাণ ইউনিটের নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে দুষ্কৃতকারী চক্রের অবাধ তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে। ম্যানগ্রোভ বনের বিভিন্ন নদ-নদী ও খালে বিষ প্রয়োগে মৎস্য শিকারের প্রবণতায় হুমকির মুখে পড়েছে বনাঞ্চলে মৎস্য সম্পদের প্রজনন ও উৎপাদন। অসাধু বনরক্ষীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নির্বিচারে চলছে মৎস্য নিধনের অনৈতিক এ কারবার। জেলে নামধারী এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারীদের অতি অল্প সময়ে বেশি মাছ আহরণ ও লাভ হলেও সুন্দরবনের প্রকৃত জেলেরা নিঃস্ব হচ্ছে। আর এ কারণে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করায় শুধু মৎস্য সম্পদই নয়, হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবনের জলজ প্রাণিও। মাছ শিকারের জন্য বন সংলগ্ন এলাকায় হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে বিষ বা কীটনাশক। পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনের অভ্যন্তরে থাকা মোট চারটি রেঞ্জের আওতাধীন ১৮টি খালে সব ধরনের জেলে প্রবেশ ও মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা চলছে। কারণ এ নিষিদ্ধ ১৮টি খালে ডিমওয়ালা মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য অবস্থান নেয়। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরায় শুধু এক প্রকারের মাছের ক্ষতি হচ্ছে না, অন্য সব প্রজাতির মাছসহ পাশাপাশি বন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনের সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ ও পর্যটন তিন মাস বন্ধ রয়েছে। তারপরও দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ পেলেই বনে প্রবেশ করে বনজ সম্পদ অবৈধভাবে আহরণের চেষ্টা করে। তাদের প্রতিহত করতে সুন্দরবনে নিয়মিত টহল কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। গেল জুনে রেঞ্জ ভিত্তিক অবৈধ উদ্ধার করা বনজ সম্পদ, আটকদের নামে মামলা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৩৯টি মামলায় ৪৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন