ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি আইনগত সামাজিক ও ধর্মীয় বিধান। যাহার উদ্দেশ্য হইল বৈধ সহবাসের অনুমতি দান এবং যাহা কেবলমাত্র যৌন সহবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে এবং তাহার আরও উদ্দেশ্য হইল সন্তান জন্ম দান ও তাহা বৈধকরণ। ইহা এমন একটি চুক্তি যাহার দ্বারা একজন পুরুষ কর্তৃক একজন নারীকে সম্ভোগের অধিকার দ্বারা দখল করা বুঝায়। যিনি কোন আইনগত বাধা দ্বারা নহেন। বিবাহ যদিও একটি ধর্মীয় দায়িত্ব তথাপি ইসলামে বিবাহ কোন সংস্কার (ঝধপধসবহঃ) নহে। ইহা ধর্মীয় আশির্বাদ সম্বলিত একটি দেওয়ানী চুক্তি। বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সরকারি খাতায় লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড করা হচ্ছে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন। বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের দলিল হচ্ছে বিবাহের একমাত্র আইনসম্মত বা বৈধ প্রমাণপত্র। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বলতে বিয়ের চুক্তির রেজিস্ট্রেশন বুঝায়। মুসলমান বিয়ের মতো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। তবে ২০০৯ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার বিধান রয়েছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম। মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ বিয়ে হয় রেজিস্ট্রেশন ছাড়া। এমনকি রেজিস্ট্রিবিহীন বিয়ে সামাজিকভাবে বৈধ ও অনুমোদিত। কিন্তু এভাবে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিয়ে সমাজে প্রশ্রয় পাওয়ায় নানা জটিলতা ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে এর ফলে নারীর দাম্পত্য অধিকার তথা মানবাধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। বহু বিয়ে, তালাক, বাল্য বিয়ে তথা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য বিয়ে রেজিস্ট্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিবাহের বৈধতা বা এ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলেই রেজিস্ট্রেশন তখন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন একদিকে যেমন বিবাহিত দম্পতির আইনগত স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তা প্রদান করে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কেননা বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হলে বিয়ের বৈধ বয়স কমপক্ষে বরের বেলায় ২১ এবং কনের বেলায় ১৮ বছর হতে হয়।
এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও সচেতনতার অভাবে তা পালিত হচ্ছে কমই। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন কে, কিভাবে করবে এ প্রশ্নে বলা যায়- মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন। তাকে আমরা কাজী বা নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে চিনি। এই কাজী একটি ইউনিয়ন/ওয়ার্ড বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এলাকার সব বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে যেদিন বিয়ে হয় সেদিনই কাজী বা নিকাহ রেজিস্ট্রার কর্তৃক বিয়ে রেজিস্ট্রার করা উচিত। তবে বিয়ের দিন কোন কারণে রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব না হলে বিয়ের ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে কিংবা বাড়িতে কাজী সাহেব ডেকে এনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।
বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময় কাজী সাহেবকে খেয়াল রাখতে হবে বিয়েতে ছেলেমেয়ের সম্মতি আছে কিনা, সাক্ষী উপস্থিত ছিল কিনা, বরের বয়স ২১ এবং কনের বয়স ১৮ হয়েছে কিনা যা প্রমাণপত্র হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক দেখতে হবে। কাজী সাহেবের আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে নিকাহনামার প্রতিটি ঘর পূরণ করানো এবং এতে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী লিপিবদ্ধ করা। যদি নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী সাহেব নিজেই বিয়ে সম্পাদন করেন তাহলে অবশ্যই তিনি বিয়ে রেজিস্ট্রার পূরণ করবেন এবং তাতে সংশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন এবং সীলমোহর দেবেন। বিয়ে অনুষ্ঠানে তিনি যে উপস্থিত ছিলেন তা অবশ্যই রেজিস্ট্রারে উল্লেখ করবেন। এই কাবিননামা বা নিকাহনামার রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন।
মুসলিম বিয়ে ও তালাক আইনের সর্বশেষ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, নিকাহ রেজিস্ট্রার নিজেই বিয়ে সম্পাদন করলে তাৎক্ষণিকভাবে বিয়েটি রেজিস্ট্রি করতে হবে। অন্য কোন ব্যক্তি বিয়ে সম্পাদন করলে নবদম্পতিকে ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রার বা কাজীকে অবহিত করতে হবে। অবহিত হওয়ার পর নিকাহ রেজিস্ট্রার তাৎক্ষণিকভাবে বিয়েটি রেজিস্ট্রি করবেন। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করার শাস্তি ২ বছরের কারাদ- অথবা ৩ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার করবেন কোন মেট্রোপলিটন বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। আমাদের দেশে বিবাহিত জীবনে নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করায় নারীরা বৈধ প্রমাণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে আইনের দ্বারস্থ হতে পারছে না। তালাক, যৌতুক, বহুবিয়ে ও নারী নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়াসহ আইনগত সব সুবিধা পেতে হলে তাই প্রয়োজন কাবিন বা বিয়ে রেজিস্ট্রেশন। তাই প্রতিটি বিয়ে যাতে রেজিস্ট্রি হয় সেজন্য আমাদের সবাইকে তৎপর ও সচেতন হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন