শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

প্রবাসীরা পাঠিয়েয়েছেন রেকর্ড রেমিট্যান্স

ঈদের আগে গ্রাহকদের ভিড়, টাকা তোলার হিড়িক কল মানি রেট রেকর্ড ৫.৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

আগামী রোববার মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। ঈদের আগে গতকাল বৃহস্পতিবার চির শেষ কর্মদিবস। এরপর টানা চারদিনের ছুটি। তাই কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের ভিড় ও টাকা তোলার হিড়িক পড়েছিল। প্রতিটি শাখায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছেন গ্রাহক। নগদ টাকা উত্তোলনের চাপে ব্যাংকগুলোর তারল্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বল্প সময়ের জন্য ধার করা আন্তঃব্যাংক লেনদেন (কল মানি রেট) রেকর্ড ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এদিকে ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নেমেছে। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ততই বাড়ছে। গত বুধবার এক দিনেই ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে এক দিনের এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক দিনে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্যাংক পাড়া মতিঝিল ও দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোতে সকাল থেকেই ক্যাশ ও জমা কাউন্টারের সামনে ছিল লম্বা লাইন। নতুন টাকার নেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন চালানপত্র, ডিপোজিটসহ বিভিন্ন সেবার বিল জমা দেয়ার লাইনও লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে অতিরিক্ত গ্রাহকের চাপে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের কর্মকর্তাদের বেশ চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে। মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজার মো. রেজাউল করিম বলেন, ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস ভিড় তো হবেই। অনেকে বাড়ি যাবে, কোরবানি দেবে এজন্য নগদ টাকা তুলছেন। আবার আমাদের এ শাখায় অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট রয়েছে তারাও তাদের কর্মীদের বেতন-বোনাস দেয়ার জন্য টাকা উত্তোলন করছেন। সব মিলিয়ে গতকাল সকাল থেকেই ছিল প্রচুর গ্রাহক।
নতুন টাকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মো. রবিউল হক জানান, ঈদ করতে বিকেলে গ্রামের বাড়ি যাবো। মতিঝিল এসেছি নতুন টাকা নেয়ার জন্য। আধা ঘণ্টা হয়েছে। আরও কিছু সময় দাঁড়াতে হবে। ঈদের নতুন টাকার আনন্দ অন্য রকম। বাড়ির ছোট বড় সবই ঈদের সালামিতে নতুন টাকা পছন্দ করে। তাই একটু সময় লাগলেও দাঁড়িয়ে অপেক্ষ করছি।
এদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বল্প সময়ের জন্য ধার করা আন্তঃব্যাংক লেনদেন (কল মানি রেট) রেকর্ড ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার কল মানি মার্কেটের রেট ছিল সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ কল মানি রেট, ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ রেকর্ড করা হয় ২০২০ সালের ২০ জুন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৩ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত এই রেট ৫ দশমিক ১ থেকে ৫ দশমিক ৩ এর মধ্যে ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান তারল্য সঙ্কট ছাড়াও রিপারচেস অ্যাগ্রিমেন্টের (রেপো) হার পরপর দু’বার বৃদ্ধি হওয়ায় কল মানি রেট বেড়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট স্বল্প সময়ের মধ্যে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করার কারণে আন্তঃব্যাংক লেনদেন কল মানি রেট বেড়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২৯ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত করে। দেখা যায়, গত ৩ জুলাই কল মানি মার্কেটে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। সেদিন মার্কেট রেট ছিল ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও গত মঙ্গলবার রেট ছিল ৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এক দিনের ব্যবধানে এ রেট বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। যা গত ছয় বছরের মধ্যে কখনো হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোভিড সংক্রমণ কমে আসার পর দেশের আমদানি ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের ডলারের চাহিদা বেশি ছিল। সেই অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে গিয়ে অধিক টাকা খরচ করতে হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের পরিমাণ কমে এসেছে।
এদিকে ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নেমেছে। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ততই বাড়ছে। গত বুধবার এক দিনেই ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে এক দিনের এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক দিনে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। বৃহস্পতিবারও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরের চেয়েও বেশি দামে রেমিট্যান্স দেশে আনছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৯৫/৯৬ টাকায় প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশে আনছে। এ হিসাবে টাকার অঙ্কে এই এক দিনে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নমুখী ধারায় শেষ হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছর। ৩০ জুন শেষ হওয়া এই অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
আগামী ১০ জুলাই দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশুসহ প্রয়োজনীয় অন্য কেনাকাটা করতে অন্যান্যবারের মতো এবারও পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। সে কারণেই রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি ঈদের পর মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে (১ থেকে ৬ জুলাই) ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গড়ে প্রতিদিন এসেছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে (১ থেকে ৫ জুলাই) এসেছিল ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৬ জুলাই বুধবার এসেছে ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে কোনো ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি। রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনের কারণে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা আর নামবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এবার আকুর আমদানি বিল একটু কম এসেছে, ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। গতকাল বৃহস্পতিবার এই বিল পরিশোধ করা হয়। তাই এদিন রিজার্ভ বেশ খানিকটা কমে আসবে। তবে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামবে না। অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। ঈদের আগের এক দিনের রেমিট্যান্স যোগ হলে তা আরও বাড়বে। তখন সেখান থেকে ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার চলে গেলে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই অবস্থান করবে।
আমদানি ব্যয় বাড়ায় গত ৯ মে আকুর রেকর্ড ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর সপ্তাহ খানেক রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় কয়েক দিন পর অবশ্য তা ৪২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করায় সেই রিজার্ভ ফের ৪২ ডলারের নিচে নেমে আসে; একপর্যায়ে তা ৪১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। এর আগের মেয়াদে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মেয়াদে আকুর ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল শোধ করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
আবির ৮ জুলাই, ২০২২, ৫:৪৭ এএম says : 0
প্রবাসীরা আমাদের দেশের চালিকাশক্তি। তারা আছে বলেই আমরা দ্রুত উন্তত হচ্ছি। প্রবাসীদের ভালো-মন্দ আমাদের সরকারের খেয়াল রাখা দরকার
Total Reply(0)
আবির ৮ জুলাই, ২০২২, ৫:৪৮ এএম says : 0
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক দিনে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
Total Reply(0)
আবুল ৮ জুলাই, ২০২২, ৫:৫১ এএম says : 0
অনেক সময় আমরা দেখি প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে কষ্টে আছে, কিন্তু তাদের খোঁজ সরকার নিচ্ছে না, পরে সব হারিয়ে তারা চলে আসতে হয়। সাথে সাথে সরকার তাদের খোঁজ নিলে এমনটা হয় না
Total Reply(0)
Nasiruddinchowdhury ১২ জুলাই, ২০২২, ৯:৫১ এএম says : 0
রাষ্ট্রের সব স্পর্ষশকাতর বিষয় এভাবে প্রকাশ করা উচিৎ নয়। সাধারনত পৃথিবীর অন্যান্য দেশও এগুলো নিয়ে এতো ওপেন প্রচারণা করেনা।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন