শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

শুল্ক গোয়েন্দা ও অমদানিকারক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

২৭ কোটি টাকার গাড়ি বিতর্ক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

কোনো প্রকার শুল্কায়ন ছাড়াই মিথ্যা তথ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে ২৭ কোটি টাকা দামের বিশ্ববিখ্যাত রোলস রয়েস ব্র্যান্ডের একটি বিলাসবহুল গাড়ি খালাস করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষনের পরে ঢাকার বারিধারা থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা গাড়িটি জব্দ করেছেন। গাড়িটির মালিক বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্য অনন্ত ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির। তার নিজ বাড়ি থেকেই গাড়িটি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। গত ২৭ এপ্রিল গাড়িটি যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে আমদানি করে বাংলাদেশি ও চীনা নাগরিকের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জেড এন্ড জেড ইন্টিমেটস লিমিটেড। আমদানির পর গত ১৭ মে রাতে গাড়িটি স্থানীয় ইপিজেড থেকে সরিয়ে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কাস্টমসের তথ্যমতে, গাড়িটিতে শুল্ক আসবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা।

এদিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ গাড়ি জব্দের পর শুল্ক গোয়েন্দা ও গাড়ির অমদানিকারকরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। শুল্ক গোয়েন্দা বলছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২০০০ সিসি’র বেশি গাড়ি অমদানির সুযোগ নেই। আর আমদানিকারক বলছেন, এটা এসিবি জিপ তাই আমদানির ক্ষেত্রে কোনো সিসি লিমিট নেই।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এই গাড়ির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি ৬ হাজার ৭৫০। এ ধরনের গাড়িতে শুল্ককর দিতে হয় শুল্কায়িত মূল্যের আটগুণ। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল ধরণের এ গাড়ি উৎপাদনের সাল ২০২১। মডেলের নাম কুলিনান এসইউভি। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জানায়, চট্টগ্রাম ইপিজেডের হংকং ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড ভুল তথ্য দিয়ে গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করে। যার বি/ই- ১২৩৭৯২, তারিখ: ২৭/০৪/২০২২ খ্রি.। গাড়িটি এস.আর.ও ১০১/আইন/২০১০/২২৮০/কাস্টমস ও মূসক অনুযায়ী সিপিসি ১৭০ এর সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি করা হয়েছে।
এদিকে গাড়িটি জব্দের পর শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোবেরা খানম ইনকিলাবকে বলেন, আমদানিকারক যে বিধিতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়িটি আমদানি করেছেন, তাতে দুই হাজার সিলিন্ডার ক্যাপাসিটির গাড়িতে এ সুবিধা পাওয়ার কথা। তবে আমদানি করা গাড়ির বনেটে স্টিকার অনুযায়ী এটির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি ৬ হাজার ৭৫০। অর্থাৎ শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে গাড়িটি আমদানি বাবদ ২৪ কোটি টাকা শুল্ককর দিতে হবে। বিষয়টি ঢাকা ও চট্রগ্রাম কাস্টমস হাউস যাচাই করছে।
মোবেরা খানম বলেন, আমদানির পর থেকেই আমরা গাড়িটির অবস্থান সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কারণ গাড়িটি কেন এতোদিন পরে আছে এ নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু চট্রগ্রাম কাস্টমস হাউস কি কারণে এতোদিন গাড়ির ছাড়করণ পেন্ডিং রেখেছে তা বলতে পারছি না। তবে আমদানিকারক বেআইনিভাবে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া না করেই গাড়িটি গ্যারেজে লুকিয়ে রেখে শুল্ক আইনের বিধান ভঙ্গ করেছেন। এমনকি গাড়িটি অবৈধভাবে ঢাকার রাস্তায় তার ছেলে চালিয়েছেনও। এ ক্ষেত্রে চোরাচালান হিসেবে গণ্য হওয়ার অপরাধ হয়েছে। জব্দ করা গাড়িটি ঢাকা কাস্টম হাউসের শুল্ক গুদামে জমা দেয়া হয়েছে। এখন চট্রগ্রাম কাস্টমস হাউস অ্যাসেসমেন্ট করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। তাদের সিদ্ধান্তের ওপরই গাড়ির ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তবে গাড়িটির আমদানিকারক এখন এসআরও বেনিফিটও পাবেন না বলে উল্লেখ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক। এমনকি গাড়ির মালিক অভিযানের সময় আমার কাছে অ্যাসেসমেন্ট কমপ্লিট করার জন্য সময় চেয়েছিল। কিন্তু আইন অনুযায়ী তা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
অপরদিকে আমদানিকারক শরীফ জহির ইনকিলাবকে বলেন, আমরা বাংলাদেশ রফতানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) পারমিটেড। গাড়ি আমদানির সুযোগ রাখি। বেপজা পিআই থেকে শুরু করে কত সিসি এবং ইম্পোর্ট পারমিট অনুমোদন দেয়। বিএল থেকে শুরু করে প্রত্যেক জায়গায় স্পষ্ট করে লেখা থাকে। এখানে শুল্কের কোনো বিষয় নেই। তিনি বলেন, গাড়ি আনা হয়েছে এপ্রিল মাসে এবং এটি চিটাগং ইপিজেড-এ এনে কাস্টমস ইনস্পেকশন শেষে কন্টেইনারর খুলে আমাদের হস্তান্তর করে। এটা থাকার কথা চিটাগং ইপিজেডে আমার ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু ইনস্পেকশন শেষে গাড়ির মধ্যে একটি ডেন পড়েছিল। তাই এটাকে আমার লোকজন ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছে। মূলত ভুল হয়েছে অ্যাসেসমেন্ট কমপ্লিট হওয়ার আগে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া। আমাকে জানানো হয়, আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে অ্যাসেসমেন্ট করে ফেলবো। কিন্তু পরে আর অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। বাকি সব ঠিক আছে।
কত সিসি গাড়ি আমদানি করা যায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিডান হলে ২০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানি করা যায়। তবে এসিবি জিপ হলে তার কোনো লিমিট নেই বলে তিনি জানান। একই সঙ্গে বেপজা না বুঝে এই অনুমতি অবশ্যই দিবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনাব শরীফ বলেন, আগাম অনুমতি নিয়েই আমরা গাড়ি আমদানি করি। এটা করোনা মহামারির আগে অনুমোদন করা বলেও তিনি জানান। একই সঙ্গে আমি নিজেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। আমাকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন গাড়ির অ্যাসেসমেন্ট করেন, আমি গাড়ি ছেড়ে দিব। তাই খুব দ্রুত বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বেপজার নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ কত সিসি’র গাড়ি আমদানি করা যায় এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললেও তারা সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি।
তবে এসিবি জিপ হলে তার কোনো সিসি লিমিট নেই বেপজার উদ্বৃতি দিয়ে শরীফ জহিরের এ বক্তব্যের বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোবেরা খানম বলেন, এনবিআর’র এসআরও অনুযায়ী যে কোন সিসি’র গাড়ী শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনার সুযোগ নেই। সেডান আছে সর্বোচ্চ ২০০০ সিসি এবং মটরকার সর্বোচ্চ ২০০০ সিসি। জিপ হলো একটা গাড়ীর ব্যান্ড। আর এটা মটরকার এসইউভি। তাই ২০০০ সিসি এর বেশি শুল্ক ছাড়া আনার সুযোগ নেই।
কোন ধরনের শুল্কায়ন ছাড়াই কিভাবে গাড়িটি ছাড় হলো জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপকমিশনার এ কে এম সুলতান মাহমুদ বলেছেন, কোনো পণ্যই শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বন্দর বা শুল্ক স্টেশন থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। গতকাল নিয়ে ৭১ দিন আগে গাড়িটি আমদানি করা হলেও আমদানিকারক অজানা কারণে শুল্কায়ন করেননি। গাড়িটি কোন প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিইপিজেড এবং সেখান থেকে ঢাকায় এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুল্কসহ গাড়িটির দাম ২৭ কোটি টাকা।
সূত্র মতে, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের গোয়েন্দারা গত ১৭ মে রাতে জানতে পারে ইপিজেড থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করে একটি বিলাসবহুল গাড়ি ঢাকার বারিধারায় নিয়ে আসা হয়েছে। উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের দল বেআইনিভাবে অপসারিত উল্লিখিত গাড়িটির অবস্থান শনাক্তকরণে তৎপর হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের দলসমূহ চৌকস তৎপরতায় নিশ্চিত হন, গাড়িটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের এমডি শরীফ জহিরের বারিধারা, গুলশান, ঢাকার নিজ বাসভবনে লুকায়িত আছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে মহাপরিচালক মোবেরা খানমের নির্দেশনায় এবং যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খানের নেতৃত্বে এ দফতর হতে গঠিত নিবারক দল ৪ জুলাই বেলা সাড়ে ১০ টায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পান যে, বি/ই- ১২৩৭৯২, তারিখ: ২৭/০৪/২০২২ খ্রি.-এ উল্লিখিত ব্র্যান্ড নিউ রোলস রয়েস মডেলের কুলিনান এসইউভি, এমওয়াই-২০২১, ৬৭৫০ সিসি গাড়িটি উক্ত বাসভবনের গ্যারেজে লুকায়িত অবস্থায় আছে।
উল্লেখ্য, উক্ত বিই সংশ্লিষ্ট গাড়িটি এস.আর.ও ১০১/আইন/২০১০/২২৮০/কাস্টমস ও মূসক অনুযায়ী সিপিসি ১৭০ এর সুবিধায় শুল্ক মুক্ত আমদানি করা হয়েছে। তবে এ ধারায় ২০০০ সিসি পর্যন্ত কার আমদানির জন্য শুষ্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে। আটককৃত গাড়িটি ২০০০ সিসি’র বেশি হওয়ায় শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রাপ্য না হলে সরকারের ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে। সেক্ষেত্রে আটককৃত গাড়িটি উল্লিখিত এস.আর.ও অনুযায়ী শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা পাবে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অবশ্য ইমপোর্ট পারমিট পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি হংকং এবং বাংলাদেশের যৌথ উদ্যাগে পরিচালিত। আমদানিকারক বেআইনি পন্থায় কাস্টমস শুল্কায়ন সম্পন্ন এবং শুল্ক-করাদি পরিশোধ না করে তার ব্যক্তিগত গ্যারেজে লুকিয়ে রেখে দ্যা কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর বিধান লঙ্ঘন করায় একই আইনের সেকশন ১৬৮ এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এ দফতর হতে গঠিত নিবারক দল গাড়িটি আটক করে কাস্টম হাউস, ঢাকা এর শুল্ক গুদামে জমা প্রদান করে। এক্ষেত্রে দ্যা কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৬, ১৮, ৩২, ৮০, ১১১ এবং একই আইনের ২ (এস) অনুসারে চোরাচালান হিসেবে গণ্য হওয়ার অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। গত ২৭ মে আমদানিকৃত বি/ই দাখিল করা হলেও দীর্ঘদিন যাবৎ (৭০ দিন) কী কারণে গাড়িটির শুল্কায়ন কার্যক্রম ছুটি ছাড়করণের জন্য সম্পন্ন করা হয়নি, সে বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন