শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

কুরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

ইসলামের বিধান মৌলিকভাবে তিন ধরনের। এক. শুধু শারিরীক ইবাদত। যেগুলোর সাথে অর্থের কোন সম্পর্ক নেই। যেমন নামায, রোযা। এজাতীয় ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে সবাই সমান। তবে মাজুর-অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কিছু বিধান ভিন্ন রয়েছে। দুই. এমন ইবাদত যেগুলোর সম্পর্ক শুধু অর্থের সাথে। যেমন- যাকাত,কুরবানী। তিন. এমন ইবাদত যেগুলোর সাথে শারীরিক শ্রম এবং অর্থ উভয়টার সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- হজ্ব। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রকারের ইবাদত পালন করা সবার উপর আবশ্যক নয়; বরং নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পাওয়া গেলে তা পালন করা আবশ্যক হয়। কুরবানী যেহেতু শুধু আর্থিক এবাদত তাই এটাও সবার উপর ওয়াজিব নয়। বরং শুধুমাত্র সামর্থবান ব্যক্তিদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। হাদিস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও যে কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয় । (ইবনু মাজাহ হাদিস নং- ৩১২৩,মুসনাদে আহমদ-৮২৫৬) এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায় কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সামর্থ্য থাকা শর্ত।

অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু এবং ঋণ ব্যতিত নিসাব পরিমাণ অর্থের মালিক হবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার- ৯/৪৫৪-৫৭ যাকারিয়া)। সুতরাং গরীব, মুসাফির এর উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। তবে নেসাবের মালিক নয় এমন গরীব ব্যক্তি যদি কুরবানির নিয়তে পশু কিনে তাহলে জন্তুটি কুরবানি করা তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। (ফাতওয়ায়ে শামী- ৯/৪৬৫ যাকারিয়া।) এছাড়া কোন ব্যাক্তি চাই সে ধনী হোক অথবা গরীব যদি কুরবানির মানত করে তাহলে আইয়্যামে নহরে তা আদায় করা আবশ্যক। (বাদায়েউস সানায়ে-৪/১৯২ যাকারিয়া)।
কুরবানীর নেসাব : কুরবানির নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে (৭.৫) সাড়ে সাত ভরি, রূপার ক্ষেত্রে (৫২.৫) সাড়ে বায়ান্ন ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল সেগুলোর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়য়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। -(আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী : জীবিতদের ন্যায় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কুরবানী করা জায়েয রয়েছে। তবে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী দু’ধররেন। এক. মৃত ব্যক্তির ওসিয়তকৃত কুরবনী। যদি কেউ মৃত্যুর সময় কুরবানী করার অসয়িত করে যায় তাহলে তার ওয়ারিসদের জন্য মৃতব্যক্তির কাফন-দাফন ও ঋণ আদায়ের পর অবশিষ্ট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে কুরবানী করা ওয়াজিব। সেক্ষেত্রে উক্ত কুরবানীর গোস্ত ওয়ারিসদের জন্য খাওয়া জায়েয হবে না; বরং তা গরীব-মিসকিনদের মাঝে সদকাহ করে দিতে হবে। । [ইলাউস সুনান-১৭/২৬৯, শামী-৯/৪৭২ যাকারিয়া] পক্ষান্তরে মৃতব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে বরং ওয়ারিসগণ স্বেচ্ছায় ইসালে সাওয়াবের জন্য মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তা জায়েয রয়েছে এবং উক্ত কুরবানীর গোস্ত যেকেউ খেতে পারবে। (ফাতওয়ায়ে শামী-৯/৪৮৪ যাকারিয়া)
একান্নভুক্ত পরিবারের কুরাবনী : যদি একান্নভুক্ত পরিবার হয় বা একাধিক ভাই বা বাবা ও ছেলে যৌথ ব্যবসা করে এবং প্রত্যেকে ব্যবসার একজন অংশীদার হয়ে থাকে তাহলে ব্যবসার সমুদয় মাল ও লভ্যাংশ ভাগ করেলে যদি প্রত্যেক সদস্য পৃথভাবে নেসাবের মালিক হয় তাহলে প্রত্যেকের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। পরিবারের যেকোন একজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তা যথেষ্ট হবে না। আর যদি ব্যবাসার মাল ও লভ্যাংশ ভাগ করলে পৃথকভাবে প্রত্যেকের নেসাব পূর্ণ না হয় তাহলে কারো উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে না। (ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-৫/২৯২ যাকারিয়া, তাতারখানিয়া-১৭/৪০৫,ফাতওয়ায়ে শামী-৯/৪৫৪-৫৭ যাকারিয়া)। অবশ্য বাবার সাথে সন্তানদের যৌথ ব্যবসায় যদি বাবা মূল মালিক এবং ছেলেরা সহযোগী হয়ে থাকে তাহলে শুধু বাবার উপর কুরাবানী ওয়াজিব হবে। ছেলেদের উপর হবে না। (ফাতওয়ায়ে শামী-৬/৫০২ যাকারিয়া)
হাজীদের কুরাবনী করার বিধান : হাজীদের কুরবানী বলতে দুই ধরনের কুরবানী উদ্দেশ্য। এক. স্বাভাবিক কুরবানী যা প্রাপ্তবয়স্ক নেসাব পরিমাণ অর্থের মালিক এমন প্রাপ্তবয়স্ক মুকীম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হয়। মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয় না। সুতরাং হাজী সাহেবগণ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে তারা মুকীম থাকে তাহলে তাদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। তারা চাইলে তা ওখানে আদায় করতে পারে। আবার চাইলে নিজ দেশেও আদায় করতে পারে। তবে নিজ দেশে আদায়ের ক্ষেত্রে শর্ত হলো এমন দিনে কুরবানী করতে হবে যেদিন মক্কাতেও আইয়্যামে নহর বাকী থাকে। (দুররুল মুখতার-৯/৪৫৭ যাকারিয়া,বাদায়েউস সানায়ে-৪/১৯৫ যাকারিয়া)।
আর হাজীদের বেলায় দ্বিতীয় প্রকারে কুরবানী হলো দমে শুকর। দমে শুকর হলেও এটাকে সাধারণ মানুষ কুরবানী বলে থাকে। এ হুকুমটি মূলত ঐ সমস্ত হাজীদের জন্য যারা হজ্জে তামাত্তু বা হজ্জে কেরান করে। তাদের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ ১১,১২বা ১৩ তারিখ মিনায় একটি পশু জবায়ের মাধ্যমে দমে শুকর আদায় করতে হয়। যারা হজ্জে ইফরাদ করে তাদের জন্য এ বিধান প্রযোজ্য নয়। (সূরা বাকারা-১৯৬)। সারকথা হলো, যারা হজ্জে ইফরাদ করে তারা যদি আইয়্যামে নহরে মুকীম থাকে তাহলে তাদের উপর শুধুমাত্র উপরোক্ত প্রথম প্রকারের কুরবানী করা ওয়াজিব। আর যদি মুকীম বা নেসাব পরিমাণ অর্থের মালিক না হয়। তাহেল কিছুই ওয়াজিব হবে না। (গুনইয়াতুন নাসিক-১৭২, মাবসুতুস সারখসি-১২/১৮ বায়রুত)। পক্ষান্তরে হজ্জে তামাত্তু বা কেরান আদায়কারী আাইয়্যামে নহরে মুকীম ও ধনী হলে তাদের উপর কুরবানী এবং দমে শুকর উভয়টা ওয়াজিব। আর মুসাফির হলে শুধু দমে শুকর ওয়াজিব হবে। স্বাভাবিক কুরবানী ওয়াজিব হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন