শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক

আরাফাতে অবস্থানের মধ্যদিয়ে ১০ লাখ মুসলিমের হজ পালন

মুহাম্মদ সানাউল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৪ এএম, ৯ জুলাই, ২০২২

মানব জাতির আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়া আলাইহিস সালামের মিলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের মাধ্যমে গতকাল ইসলামের ৫ম স্তম্ভ পবিত্র আদায় করেছেন ১০ লক্ষাধিক মুসলিম। এর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের ৬০ হাজার জন। ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল-হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারীকা লাক’- অর্থাৎ উপস্থিত ‘হে আমার আল্লাহ, উপস্থিত। উপস্থিত, তোমার কোনো অংশীদার নেই, উপস্থিত। নিশ্চয় সকল প্রশংসা, নিয়ামত ও রাজত্ব তোমার, তোমার কোনো অংশীদার নেই’- এই তালবিয়াহ উচ্চারণ ও মহান আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণার মাধ্যমে আরাফাতের ময়দানকে প্রকম্পিত করে সুষ্ঠু ও নিরাপদে হজ পালন করলেন বিশ্বের নানা দেশ থেকে করোনা-উত্তর প্রথম হজে সুযোগ পাওয়া ভাগ্যবানরা। আগের রাত থেকে মোয়াল্লেমদের তত্ত্বাবধানে আরাফাতের ময়দানে আগমন শুরু হলেও গতকাল সূর্যোদয়ের পরও অনেকে আসেন। মসজিদের নামিরা ও জাবালে রহমতকে ঘিরে থাকা ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ২ কিলোমিটার প্রস্থের আরাফাত ময়দানে হজযাত্রীদের পদভারে এক মনোরম দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক আল্লাহর মহত্ব বর্ণনা ও তার নির্দেশ পালনের মাধ্যমে এদিন হাজী সাহেবরা তার কাছেই নিজেদের সমর্পণ করে দেন।

মসজিদে নামিরায় হজের খুৎবা দেন রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক হেলাল অরগানাইজেশনের চেয়ারম্যান, সউদী আরবের রাজনীতিক এবং দেশটির সাবেক বিচারমন্ত্রী শায়খ ড. মোহাম্মদ বিন আবদুল করিম আল ঈসা। আরবি খুতবা বাংলায় অনুবাদ করেন মোহাম্মদ শোয়াইব রশীদ এবং তার সহকারী ছিলেন খলিলুর রহমান।

খুতবায় ড. মোহাম্মদ বিন আব্দুল করিম আল ঈসা বলেন, ‘আল্লাহর ঘরের তীর্থযাত্রীগণ এবং সকল স্থানে হে মুসলমানগণ, আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা ইহকাল ও পরকালে বিজয়, পরিত্রাণ ও সুখ লাভ করবে’। ‘আল্লাহর এককত্বের সাক্ষ্য এবং মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর সাক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ এবং কেয়ামতের দিন নাজাতের কারণ’। ‘সাক্ষ্যের অর্থের মধ্যে রয়েছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশ্বাস, তার হাদীস, তার আদেশের আনুগত্য এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা অনুসরণে আল্লাহর ইবাদত করা’।

মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম আল-ঈসা বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর’। আল্লাহ তায়ালা নামাজ, রোজা এবং যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, হজ তোমাদের ওপর ফরজ। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তা‘আলার গ্রন্থ কোরআন অন্যান্য ঐশী গ্রন্থকে নিশ্চিত করে।

হজের খুতবায় ইমাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা শেষ নবী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা): ‘তোমার আত্মাকে পবিত্র কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর। আল্লাহ বলেছেন, তিনি ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। তিনি বললেন, মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে কল্যাণের পথে থাকে।

হজযাত্রীদের উদ্দেশে ডক্টর মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম আল-ঈসা বলেন, ইসলাম ভ্রাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। পিতামাতার পরে আত্মীয়দের সাথে সদয় হও। তিনি বলেন, উম্মাহর উচিত একে অপরের সাথে সহানুভূতির আচরণ করা।

তিনি বলেন, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উপাসনা করুন। যারা ভালো কাজ করতে তাড়াহুড়া করেন তাদের জন্য সুখবর। নবী সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সর্বোচ্চ নৈতিকতার অধিকারী আমার নিকটবর্তী হবে। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণের কোনো মান থাকলে তা হলো তাকওয়া। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পরিবার-পরিজনকে ভালো কাজের আদেশ দাও’।

আরাফার দিন প্রসঙ্গে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘সর্বোত্তম দোয়া হল আরাফার দিনের দোয়া এবং আমি এবং আমার আগে নবীরা যা বলেছেন তার মধ্যে সর্বোত্তম হল: ‘কোনো সত্য ইলাহ নেই আল্লাহ ছাড়া, তিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। তার জন্যই রাজত্ব এবং তার জন্যই সকল প্রশংসা। আর তিনি হচ্ছেন সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

হজের খুৎবার পর এক আজানে দুই ইকামতে যোহর ও আসর নামাজ কসর করে আদায় করা হয়। খুৎবায় মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম আল-ঈসা একথাটিও উল্লেখ করেন যে, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আজানে ও দুই ইকামতে যোহর ও আসর দুই দুই রাকআত করে আদায় করেছেন। নামাজ আদায়ের পর হাজী সাহেবরা তাদের নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করেন।

প্রসঙ্গতঃ আরাফাতের ময়দানে হজযাত্রীদের খেদমতে সউদী আরবের প্রসিদ্ধ কোম্পানি ছাড়াও সরকারি এনজিও নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। সউদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল কোম্পানিগুলো হাজীদের মাঝে বিতরণ করে ছাতা। বিভিন্ন কোম্পানি লাবাং, দুধ এবং মাল্টা, আপেল, ডালিমের জুস এবং পানি বিতরণ করে থাকে।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থানের পর হাজী সাহেবরা বাসে, ট্রেনে, ট্রাক বা পিক-আপে মুযদালিফায় রওনা দেন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে হাজী সাহেবদের মসজিদে মাশআরিল হারাম কেন্দ্রিক মুযদালিফার খোলা প্রান্তরে পৌঁছে মাগরিব ও এশা আদায় করেন। তারা গতরাত সেখানেই কাটান। মুযদালিফা থেকে ৪৯টি কঙ্কর সংগ্রহ করেন হাজী সাহেবরা। এজন্য বিশেষ ধরনের ছোট ছোট পাথর ছড়িয়ে রাখা হয় পুরো মুযদালিফা জুড়ে। তবে অন্য যে কোনো স্থান থেকে হাজীরা এসব পাথর সংগ্রহ করতে পারেন।

আজ সূর্যোদয়ের পর আবার মিনায় ফিরে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পূর্বে বড় জামারাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী সম্পন্ন করার পর মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম পরিত্যাগ করবেন হাজী সাহেবরা। সুযোগ বুঝে মক্কায় গিয়ে ফরজ তাওয়াফ করতে হবে ৩ দিনের মধ্যে। ১১ ও ১২ যিলহজও হাজী সাহেবদের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর ৩টি জামারাতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। যারা সংক্ষেপ করতে চান ১২ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন। নইলে ১৩ যিলহজ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর আবারও ৩টি জামারাতে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর মেরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।

পরিশেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ের দিন বিদায়ী তাওয়াফের পূর্ব পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ ও যত বেশি সম্ভব তাওয়াফে সময় কাটাবেন হাজী সাহেবরা। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সহীহ তরিকায় হজ পালন করে মাসুম বা গুনাহমুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

হাজী সাহেবদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সউদী কর্তৃপক্ষ। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মক্কা ও মদিনায় ২৩টি হাসপাতাল ও ১৪৭টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছে। এছাড়া মিনাতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে চারটি হাসপাতাল ও ২৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের জন্য প্রায় এক হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী।

এ বছর হজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন প্রায় দশ লাখ মুসলিম। পূর্ণ টিকা নেওয়া এসব মুসলিমের মধ্যে প্রায় সাড়ে আট লাখই বিদেশি নাগরিক। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দুই বছর সীমিত পরিসরে হজ পালনের পর এবারই বড় পরিসরে তা আয়োজিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হজে যোগ দেন। তবে পরের বছরগুলোতে মহামারির কারণে আকার সীমিত করতে হয়। ২০২১ সালে মাত্র সউদী আরবের মাত্র ৬০ হাজার টিকা নেওয়া বাসিন্দা হজের সুযোগ পায়। ২০২০ বছর তার চেয়েও কম সংখ্যক মানুষ সেই সুযোগ পায়।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে হজে অংশগ্রহণকারী ৬০ হাজার হজযাত্রীর মধ্যে ১৫ জন ইন্তেকাল করেছেন। ১০ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা হজযাত্রীর মধ্যে মক্কায় ১২, মদীনায় ২ এবং জেদ্দায় ১ জন ইন্তেকাল করেছেন। গত বৃহস্পতিবার মক্কায় মোকাররমায় ইন্তেকাল করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মহিলা হজযাত্রী শিরিনা আক্তার (৫৯)। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন