ত্যাগের মহিমায় যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা, আনন্দ উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপন হয়েছে। গত দুটি কোরবানির ঈদ করোনার বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি থাকায় মানুষের মধ্যে ‘ঈদ উদ্দীপনা’ কমতি ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাধ্যবাধকতায় মুসলমান সম্প্রদায় ওই দু’টি ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। ফলে ঈদ মানে যে খুশির জোয়ার সে চিত্র তেমন চোখে পড়েনি। দেশে ফের করোনা সংক্রমণ চোখ রাঙালেও এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তাই কোনো কঠোর বিধিনিষেধ না থাকায় দেশের কোটি কোটি মানুষ নতুন জীবনে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ঈদুল আজহার উৎসব উদযাপন করেছেন। আগের যে কোনো ঈদের সময়ের চেয়ে এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষকে সড়কে, নৌ পথে এবং ট্রেনে কম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু ও কর্ণফুলি সেতু সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ফলে ঘরমুখো মানুষের এবার দুর্ঘটনা-ভোগান্তি কম মোকাবিলা করেই ঘরে ফিরেছেন আবার ঈদ উদযাপনের পর কর্মস্থল ঢাকায় ফিরে আসতে শুরু করেছেন।
ঈদ প্রতিটি মুসলিম হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছিল অফুরন্ত প্রেম-প্রীতির নবজাগরণ। মুসলমানদের ধর্মীয় এই উৎসব নতুন সুর বীণায় ছন্দময় করে তুলেছিল দেশের প্রতিটি প্রান্তর; শহর-জনপদ। মানবকল্যাণের সব ধরনের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে দিয়েছিল নবচেতনায় এবং নতুন মাত্রায়। মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাথা। তাই ঈদে আনন্দের উৎসবের পাশাপাশি জড়িয়ে থাকে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে-ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। মুসলমানরা ঈদের নামাজের পর যখন পরস্পর কোলাকুলি করেন তখন ধনী-গরিবের ব্যবধান আর থাকে না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন- সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।
এবার সারা দেশে এক কোটিরও বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। বিগত দুই বছরের চেয়ে এবার চামড়ার দামও বেশি পেয়েছে মানুষ। পশু কোরবানীর পর ৪০ ঘন্টায় রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন বজ্য পরিস্কার করেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার হাতিরঝিল, মিরপুর চিড়িয়াখানা, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, পার্বত্য তিন জেলা, নরসিংদীর হালিডে ড্রিমল্যাণ্ড, রাজশাহীর পদ্মার চর, সিলেটের বিভিন্ন বিনোদনস্পট, উত্তরাঞ্চলের ভিন্নজগতসহ সারাদেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভীড় দেখা গেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সেক্টরে লাখো কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে।
ঈদের আনন্দ একা উদযাপনের বিষয় নয়। এই ধর্মীয় উৎসব ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব আর সাম্যেরও উপলক্ষ। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে সবার মাঝে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই ঈদের সার্থকতা নিহিত। চারপাশে গরিব-অসহায় মানুষ আছে, এবারের বন্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে, তাদের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়িয়েছেন সমাজের বিত্তবানরা। করোনা বিধিনিষেধ শেষে এবার চিরাচরিত রূপে ফিরেছে ঈদের আনন্দ-উৎসব। ঈদের দিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বের হয়েছেন। পথে পথে উৎসব করছেন। ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে অনাবিল আনন্দ বলে দেয় তারা ঈদুল আজহায় নিজ নিজ অবস্থান থেকেই উপভোগ করছেন।
দুই বছর পর জাতীয় ঈদগাহে ঈদুল আজহার প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাখালিস্থ মসজিদে গাউসুল আযম কমপ্লেক্্ের ৪টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সকালে ঈদের জামাতে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে ঘোষিত হয় সাম্য, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের মহিমা। এরপর আল্লার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি দিয়েছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
সকাল ৭টা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়ক, অলি-গলি সর্বত্র কোরবানি হতে থাকে গরু কিংবা খাসি। কিশোর-তরুণ-বৃদ্ধ সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোরবানির পশুর গোশত কাটাকুটিতে লেগে যায়। বিভিন্ন এলাকায় পশু জবাইয়ের চিত্র বলছে, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী গতবারের চেয়ে এবার ৮ লাখ বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এবার সকাল থেকেই পশু কোরবানি দেখার পাশাপাশি এবাড়ি-ওবাড়ি, এপাড়া-ওপাড়া করতে দেখা যায় ছোট ছেলেমেয়েদের। কোরবানির গোশত গরীব-দু:খি মানুষের মাঝে বিলিয়েছেন বিত্তবানরা। তাই বিকেলে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অলিগিলি ও বিশেষ বিশেষ এলাকায় দেখা যায় কোরবানির গোশতের হাট বসেছে। নিম্নবিত্ত অনেকেই সেখান থেকে কম দামে গোশত ক্রয় করেন।
ঈদের দুপুর না গড়াতেই কোরবানির গোশত রান্নার ম-ম গন্ধ ছড়াতে থাকে এলাকার বাসাবাড়ির আশপাশে। শুরু হয় আপ্যায়ন। একই সঙ্গে চলে আত্মীয়, পাড়া-পড়শির জন্য গোশত পৌঁছে দেওয়ার ব্যস্ততা। ঈদের দিন রাজধানী রাজধানী অনেকটা ফাঁকা ছিল। দুপুরের পর রাজধানীর সড়কগুলো মানুষ ও যানবাহনের বেশ ভিড়। গণপরিবহনের বেশির ভাগ যাত্রী গোশত নিয়ে ছুটছেন আত্মীয় বাড়ির দিকে। এই ধর্মীয় উৎসব ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব আর সাম্যেরও উপলক্ষ। সবার মাঝে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই এর সার্থকতা নিহিত। আসমানি কিতাব আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত-৩৭)।
আনন্দের শেষ নেই : ঈদুল আজহার ছুটি শেষে যখন এক এক করে মানুষ রাজধানীমুখী হতে শুরু করছে; তখনও অনেকটাই ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে, গাবতলী, মহাখালি, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। গতকাল মঙ্গলবার ঈদের তৃতীয় দিনেও ঘরমুখী মানুষের ভিড় দেখা গেছে কমলাপুর রেল স্টেশনে। ঘরমুখী এসব মানুষের অনেকেই আবার টিকিট সংকটে পড়েছেন বলে জানান। ঈদের পরেও বাড়ি যেতে পরিবার নিয়ে মানুষ স্টেশনে আসছেন। যারা ঢাকা ছাড়ছেন, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বাস টার্মিনালগুলোতে দেখা গেছে শত শত মানুষ ঈদের পর গ্রামে যাচ্ছেন। কারো হাতে বোচকা পোটরা কারো হাতে কোরবানির গোশতের ব্যাগ। ঈদের আমেজ যেন শেষ হচ্ছে না। মোছা. মমতা বেগম। যাবেন পাবনা। তিনি বলেন, ঢাকায় ঈদের আনন্দ করেছি। এখন ঈদের পরে বাড়ি যাচ্ছি। গ্রামে আত্মীয়-স্বজহনদের সঙ্গে ঈদের বাকি আনন্দ ভাগাভাগি করে নেব।
চামড়ার দাম বেড়েছে : গত কয়েক বছর ধরে সিণ্ডিকেট করে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে ধ্বস নামিয়ে দেয়া হয়। এবার চামড়ার দাম আগের চেয়ে ভাল এবং আগের চেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। কাঁচা চামড়া বেচাকেনার জন্য বিখ্যাত রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকা। শুধু রাজধানীর নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ করে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে কাঁচা চামড়া আসে। বিগত বছরগুলোতে ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনে চামড়া বেচাকেনার ধুম পড়লেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। চামড়ার গাড়ির কারণে পোস্তা এলাকার যানজটের সেই দৃশ্যও নেই। আড়তদাররা চামড়া লবণ মাখিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর গত মঙ্গলবার বেশিরভাগ আড়ত ফাঁকা দেখা যায়। জানা গেছে, আগে ঢাকার বাইরে থেকে পোস্তায় চামড়া আসলেও এখন গরমসহ নানা কারণে ঢাকায় আসছে না। স্থানীয়ভাবেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। ক্রেতা বিক্রেতা সবাই বলছেন আগের চেয়ে এবার চামড়ার দাম বেশি। চামড়ার আরেক আরেক আড়ৎ সাভার। সেখানেও সারাদেশ থেকে আসা চামড়া ভাল দামে বিক্রি হয়েছে।
হারিয়ে যেতে নেই মানা : রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিনোদন স্পট গুলোর দৃশ্য ছিল যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’। ঈদের খুশিতে মানুষ যেন হারিয়ে গিয়েছিল। পটুয়াখালির কুয়াকাটায় হাজার হাজার মানুষকে উৎসব করতে দেখা গেছে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে লাখো মানুষের পদচারণা জানান দেয় মানুষ ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে জীবনকে কত আনন্দদায়ক করেছে। সিলেটের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র, খুলনার সুন্দরবন দর্শনার্থীর পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। রাজধানী ঢাকার হাতির ঝিল, মীরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা, বিভিন্ন পার্ক, সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনে তিল ধরনের ঠাই ছিল না। নরসিংদীর ড্রিম হলিডে লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে। দিনাজপুরের রাম সাগর, রংপুরের ভিন্নজগৎ, নীলফামারীর রসুলপুরে থিমপার্ক, পাতাকুঁড়ি বিনোদন পার্ক ও রংধনু পাক, রাজশাহী শহরের পদ্মার তীর ঘেষে গড়ে উঠা বিনোদন পার্কসহ কোনো পার্কে দর্শনার্থীর কমতি ছিল না। প্রতিটি পার্কের সহজ যোগাযোগের কারণে দর্শনার্থীরা সব সময় ভিড় করে থাকেন। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য প্রতিটি পার্কে সেরকম ব্যবস্থা করেন পার্ক কর্তৃপক্ষ।
হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা : ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সেক্টরে কত হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। তবে কেবল ডিজিটাল হাটে এ বছর ৭৩০ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এবার সারাদেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। ৮ বিভাগের কোরবানির হিসেব তারা তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। তবে ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে গরু-মহিষ কোরবানি বেশি হয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, এ বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ডিজিটাল পশুর হাট’-এ ৭৩০ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এই প্লাটফর্মে আঞ্চলিক হাটের ৫৯ হাজার ৪৮১টি এবং খামারিদের ১৭ হাজার ৫০২টি পশু বিক্রি হয়। এটুআই-এর কমিউকেশনস অ্যান্ড আউটরিচ কনসালট্যান্ট আদনান ফয়সাল গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ডিজিটাল হাটের ওয়েবসাইটে ২১ লাখ ৬ হাজার ৮৪২টি হিট পড়েছে। আঞ্চলিক হাটের ৫৮৭ কোটি ও খামারিদের ১৪৩ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে। সবমিলে ডিজিটাল হাটে ৭৩০ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দেশে এক কোটিরও বেশি কোরবানির পশু কেনাবেচা হয়ে থাকে। জনসমাগম ও ভোগান্তি কমাতে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো অনলাইনে প্ল্যাটফর্মে (ডিজিটাল পশুর হাট) কোরবানির পশু কেনাবেচা শুরু হয়। এই হাটের মাধ্যমে ২০২০ সালে ২৭ হাজার এবং ২০২১ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার পশু বিক্রি হয়।
ঘরে বসে নিজেদের পছন্দের কোরবানির পশু কেনার সুযোগ করে দিতে এ বছর আরও বড় পরিসরে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ডিজিটাল হাটে গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট ও মহিষ ক্যাটাগরিতে দেশের ৯৫০টিরও অধিক হাটকে যুক্ত করা হয়। যুক্ত ছিল বিভিন্ন এলাকার ৭০টি খামার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন