শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রি-আত্মসাত

উপেক্ষিত হাইকোর্টের রায় : ৯০ ভাগ সম্পত্তি বেহাত : দুদকের ‘ব্যবস্থা’ নামকাওয়াস্তে

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রি এবং হস্তান্তরের বিধান অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন এ সংক্রান্ত বিশেষ ধারা এবং আইনের বিধান। কিন্তু এই রায়কে বুড়োআঙুল দেখিয়ে চলছে বিক্রি, হস্তান্তর, জবরদখল এবং ভোগ-দখল। ওয়াকফকৃত সম্পত্তি আত্মসাত, বিক্রি, জবরদখলের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করলেও তা নামকাওয়াস্তে। আত্মসাতকৃত ওয়াকফ সম্পত্তির আর্থিক মূল্য এবং দুদকের এজাহারে উল্লেখিত সম্পত্তির মূল্য নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য। ফলে দুদকের ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ এবং হাইকোর্টের রায় কোনোটিরই কার্যকর প্রতিফলন নেই। অব্যাহত রয়েছে ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি ও আত্মসাৎ। ওয়াকফ এস্টেটের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধূর্ত সমাজপতি পরস্পর যোগসাজশে নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন শত শত কোটি টাকা মূল্যের ওয়াকফ সম্পত্তি।
উপেক্ষিত হাইকোর্টের রায় : একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ওয়াকফ হস্তান্তর ও উন্নয়ন আইনের ৩টি ধারা ও একটি দফা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের মধ্য দিয়ে ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃক সম্পত্তি হস্তান্তর, বিক্রি বা রিয়েল স্টেট কোম্পানিকেও দিতে পারবেন না। রায়ে ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) আইনের ৩, ৪(চ), ৮ ও ১২ ধারা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
বিচারপতি তারিক উল হাকিম এবং বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ ওই রায় দেন। রিটের পক্ষে শুনানি করেছিলেন মরহুম অ্যাডভোকেট এ বি এম নূরুল ইসলাম এবং অ্যাডভোকেট গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ। ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে হাইকোর্টের ওই রায় ছিল যুগান্তকারী। মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত অ্যাডভোকেট (বর্তমানে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা:) তাঁর জীবদ্দশায় ওয়াকফের বিধান চালু করেন। এটি কোরান নির্দেশিত পন্থা। যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পত্তি রয়েছে, তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ওয়াকফে তার সম্পত্তির কিছু অংশ দান করে থাকেন। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে ৩টি উদ্দেশ্যে ব্যয় করার বিধান রয়েছে। ধর্মীয়, দাতব্য ও মানবহিতৈষী কাজে। অন্য কোনো কাজে এ সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য নয়।
এই আইনজীবী আরো বলেন, ২০১৩ সালের সরকার বিশেষ আইন ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) প্রণয়ন করে। এ আইনের ৩ ধারায় আইনটিকে সব আইনের ওপরে প্রাধান্য দেয়া হয়। একই সঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তরের বিধান রাখা হয়। আইনের ৩ ধারায় আইনের প্রাধান্য ৪ (চ) ধারায় হস্তান্তর পদ্ধতি-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়নের জন্য হস্তান্তরের মাধ্যমে, ৮ ধারায় হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে বিশেষ কমিটি এবং ১২ ধারায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়নের জন্য হস্তান্তরের বিধান রয়েছে।
আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রশাসক-ওয়াকফ সম্পত্তি ঢাকায় বসে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে হস্তান্তর বা অংশীদারিত্বের দেখভাল করেন। ওই কমিটিতে মোতাওয়াল্লি, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বা প্রশাসন সম্পৃক্ত নন। ফলে বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে যায়। হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি করে আইনের ৩টি ধারা ও একটি উপধারা বাতিল ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ের ফলে ওয়াকফ প্রশাসকের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। তিনি আর সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন না।
এর আগে ২০১৩ সালে ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) আইনের বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিটের পর ওই বছরের ২৯ এপ্রিল রিট করা হয়। হাইকোর্ট আইনটি কেন অসাংবিধানিক এবং ওয়াকফ সংক্রান্ত অন্যান্য আইনের পরিপন্থী হবে নাÑ এই মর্মে রুল জারি করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুলটি ‘যথাযথ’ ঘোষণা করা হয়।
থেমে নেই বিক্রি-জবরদখল : ঢাকার কালুনগর মৌজার ৫২ শতক জমি এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেটের। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই জমির মালিকানা দাবি দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। পক্ষটি বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে এস্টেটের কিছু অংশ বিক্রিও করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তিটির মোতাওয়াল্লি অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে ঢাকা জেলা প্রশাসনকে চিঠির পর চিঠি দিলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এখানকার একেক শতক জমির বর্তমান মূল্য ৪০ লাখ টাকার বেশি। এ হিসেবে ৫২ শত সম্পত্তির মূল্য ২০ কোটি টাকারও বেশি। ১৯৪৪ সালে হাজারীবাগ রোডে কালুনগর মৌজার ৫২ শতাংশ জমি এনায়েত বিবির নামে ওয়াক্ফ দলিলের মাধ্যমে ওয়াক্ফ লিল্লাহ করে দেন তার স্বামী বোরহান মিয়া। এই জমির সিএ ও এসএ দাগ নম্বর ১৮৭, ওয়াক্ফ রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৪৩৪৮। দলিলে আবদুল বারেক সরদার, চাঁন মিয়া ও রবিউল্লাহ নামে ৩ জনকে মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে রবিউল্লাহ ছিলেন এনায়েত বিবির একমাত্র সন্তান। রবিউল্লাহর ইন্তেকালের পর তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে দলিল করে এই ওয়াক্ফ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করেন সলিমুল্লাহসহ ৬ ব্যক্তি। তবে এই দলিল জাল বলে জানান স্থানীয়রা। পরে জায়গাটি দখল করে তারা প্লট তৈরি বিক্রি করে দেন।
এদিকে রাজধানীর মগবাজারে পেয়ারাবাগে ১৯৪০ সালে ১ একর ৩৮ শত সম্পত্তি ওয়াকফ করেন ফকির মাহমুদ। এ সম্পত্তির ওপর এখন আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। রয়েছে বাজার, স্কুল, মাদরাসা ও মসজিদ। দীর্ঘদিন এই সম্পত্তি নিয়ে খুব একটা জটিলতা সৃষ্টি না হলেও প্রশ্ন ওঠে ২০০৯ সালে। জনৈক আলমগীর সিদ্দিককে সম্পত্তির মোতাওয়াল্লি নিয়োগে সম্পত্তির অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আসতে থাকে। ২০১৬ সালে আলমগীর সিদ্দিককে সরিয়ে নতুন মোতাওয়াল্লি নিয়োগের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু সেই নির্দেশ কার্যকর করেনি বাংলাদেশ ওয়াকফ এস্টেটের প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, দখলে থাকা মোতাওয়াল্লি সরকারদলীয় একজন স্থানীয় নেত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফকির মাহমুদ ওয়াকফ এস্টেটের অন্তত ১৫ কাঠা জমি দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া ২০১৪ সাল থেকে সম্পত্তির বাণিজ্যিক স্থাপনা থেকে কোটি টাকা ভাড়া আদায় করে আত্মসাত করছেন। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করছেন ওয়াকফ এস্টেটেরই কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
ওয়াক্ফ প্রশাসন সূত্র জানায়, শুধু পেয়ারাবাগের সম্পত্তিই নয়। প্রভাবশালী মহল ওয়াকফ এস্টেটের উত্তরাধিকার এবং ওয়াকফ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অধিকাংশ সম্পত্তি বিক্রি ও দখল করে চলেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রমে জেঁকে বসা দুর্নীতির কারণে ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় ৯০ ভাগ সম্পত্তিই এখন অবৈধ দখলদারদের করায়ত্তে। সারাদেশে যার পরিমাণ ১ লাখ একরের বেশি। ওয়াকফ প্রশাসনের অধীন প্রায় ৫ হাজার ওয়াকফ এস্টেট প্রশাসকের কোনো কার্যক্রম নেই।
এর আগে বিদ্যমান বাস্তবতায় ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তীব্র অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরে বেহাত হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করে দেয় সংসদীয় কমিটি। তবে উপ-কমিটি গত কয়েক বছরে কি কাজ করেছে- সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
নামকাওয়াস্তে মামলা দুদকের : ওয়াকফ এস্টেট সরকারি সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু দেশের শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি যখন হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থা-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সংস্থাটি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় দু-তিন কোটি টাকার ওয়াকফ সম্পত্তি আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ চট্টগ্রামের হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) দরগাহ শরীফের আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে দুদক। গত বছর ৩০ জুন সংস্থার তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো: ফখরুল ইসলাম বাদী হয়ে ৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। আসামিরা হলেনÑ জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির অংশীদার মো. রফিকুল ইসলাম, ইয়াজ্জেম হোসেন রোমেন ও মো. হারুনুর রশিদ। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত শর্তভঙ্গ এবং সরকারের ক্রয়-বিক্রয় নীতিমালা/পিটিআর এর আইনভঙ্গ করে পুরাতন মসজিদের মালামাল বিনা টেন্ডারে বিক্রয় ও বাণিজ্যিক ভবনের দোকান বরাদ্দের নামে ৪৬ ব্যক্তির কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা আদায় এবং আত্মসাত করেন।
এর আগে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার ‘হাফিজউদ্দিন খন্দকার ওয়াকফ এস্টেট’-এর সম্পত্তি বিক্রির অভিযোগে মামলা করে দুদক। মামলায় এস্টেটেরমোতাওয়াল্লি মো. মাইনুল করিমের বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এস্টেটের ৪৫ শতক জমি ৩ কোটি ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয় হাসান জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম শাফিকুল হাসানের কাছে। কিন্তু বিক্রীত সম্পত্তির অর্থ এস্টেটের তহবিলে জমা করা হয়নি। সংস্থার সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকী মামলাটি তদন্ত করছেন।
সরকারি সম্পত্তি তথা ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি-হস্তান্তর এবং আত্মসাতের অজস্র ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা নামকাওয়াস্তে। এরই মধ্যে বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই। শাস্তির ভয় না থাকায় ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি-হস্তান্তর এবং আত্মসাতের ঘটনা বেড়েই চলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
৯০ ভাগ ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেলেও গত দেড় দশকে কি পরিমাণ সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা হয়েছেÑ জানতে ওয়াকফ এস্টেটের প্রশাসক খান মো. নূরুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার তার সরকারি ফোনটি সারাদিনই বন্ধ পাওয়া যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন