আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বৃষ্টির বদলে বইছে তীব্র তাপদাহ। ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন। মাঠঘাট ফেটে চৌচির। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে দেশের ১৭টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে মৃদু তাপপ্রবাহ। এটি আরো চার দিন অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রাজশাহীতে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের কারণে এই তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি অনুভূত হচ্ছে। তবে সারাদেশের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। ভরা বর্ষা মৌসুমের মধ্যভাগে এসেও চৈত্র-বৈশাখের মতো ভ্যাপসা গরমে নাকাল সারাদেশের মানুষজন। তীব্র তাপদাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জীবনযাত্রা। অস্বাভাবিক তাপদাহের কারণে ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহে প্রচণ্ড গরমে জনজীবনেও হাঁসফাঁস অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে কোথাও অতিরিক্ত জনসমাগম হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। গরমের দিনে মারাত্মক সমস্যার একটি নাম হিট স্ট্রোক। এর প্রধান কারণ পানিশূন্যতা। মানব দেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে প্রবল। এ অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিট স্ট্রোক হয়। হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলোÑ মাথা ঝিম ঝিম করা, বমি বমি ভাব বা বমি করা, অবসাদ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মাংসপেশির খিঁচুনি, চোখে ঝাঁপসা দেখা, হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টিবিভ্রম, খিঁচুনি ইত্যাদি।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, দেশে এখন করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ রয়েছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষের বিভিন্ন ধরনের অসুখ, সর্দি-কাশি, জ্বরও হচ্ছে। এর সাথে প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিও যুক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় যারা শ্রমিক শ্রেণি রয়েছে, তাদের তো বাইরে কাজ করতেই হয়। তারা যাতে মাঝেমধ্যে ছায়ায় অবস্থান করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি বেশি পানির পাশাপাশি হালকা লবণযুক্ত পানি, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি পান করতে হবে। ডিহাইড্রেশন যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই বর্ষাকালে সকালে সূর্যের আলো ফুটতেই গরম শুরু হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অসহ্য গরম থাকে। সন্ধ্যার পর গুমট হয়ে ওঠে পরিবেশ, রাতেও ভ্যাপসা গরম। এমন অবস্থায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দিনের বেলা স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি দরকার ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট হয়ে উঠেছে অসহনীয়।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুপুর হতেই অলি-গলিতেও লোকজনের চলাফেরা একেবারে কম। অনেকে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যান।
শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, গরমের কারণে এমনই ‘অস্থির’ অবস্থা বিরাজ করছে সারাদেশে। আবহাওয়া পরিস্থিতি বিদ্যুতের লোডশেডিং, জ্বালানি ও পানি সরবরাহের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। অধিক তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলেরও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কিছু দীর্ঘমেয়াদি কারণ রয়েছে। যখন এক দেড় ঘণ্টার কালবৈশাখী হয়, তখন অন্তত দেড়শ’ থেকে দুইশ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এবার কালবৈশাখীতে বৃষ্টি হয়নি। এজন্য তাপমাত্রা কমছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, ভয়াবহ গরমের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ‘লা নিনা’ নামের এক বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবেই আবহাওয়া দ্রুত এমন দুর্যোগপূর্ণ হচ্ছে। এটা আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। সরকারকে এখনই জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।
ইনকিলাবের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা জানান, অব্যাহত দাবদাহে পুড়ছে প্রাণ-প্রকৃতি। টানা কয়েকদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেশি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও প্রায় ৩৯ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে সুপেয় পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক জানান, বর্তমানে ঢাকা, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলা ও সিলেট বিভাগের ৪ জেলাসহ মোট ১৭ জেলায় মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা অব্যাহত থাকতে পারে আগামী রোববার পর্যন্ত। ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে সংস্থাটি জানায়, গতকাল রংপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া ভারতের ওড়িশা উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি একই এলাকায় অবস্থান করছে। এর বর্ধিতাংশ পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি ১৭-১৮ জুলাইয়ের দিকে বৃষ্টি কিছুটা বাড়তে পারে। এতে ভ্যাপসা গরম কিছুটা কমে আসতে পারে। তাপমাত্রা যতটুকু তার চেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। কারণ, বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, ১৬-১৭ জুলাই পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই থাকতে পারে। মাঝেমধ্যে কোথাও হালকা বৃষ্টি হলেও গরম খুব একটা কমবে না। গরম কমতে হলে টানা বৃষ্টি হতে হবে। ১৭ বা ১৮ জুলাইয়ের পর বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এখন যেসব এলাকার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তার তাপমাত্রা; কিন্তু এখনও মাইল্ড অবস্থায়ই আছে। গড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই। এদিকে মৌসুমী বায়ুর কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। গরমে ঘেমে গেলেও ঘাম শুকাচ্ছে না। ফলে ভ্যাপসা একটা ভাব তৈরি হচ্ছে। এ কারণে যতটুকু তাপমাত্রা বেড়েছে তার চেয়ে বেশি তাপ অনুভূত হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, মৌসুমী বায়ুর অক্ষ ভারতের রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি ধরনের সক্রিয় রয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে, ৩৮ দশমিক ২। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সৈয়দপুরে ৩৮.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর তৃতীয় সর্বোচ্চ দিনাজপুরে ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া সিলেটে ৩৭.৩ ডিগ্রি, শ্রীমঙ্গলে ৩৭.২ ডিগ্রি, রংপুর, বগুড়া ও ঈশ্বরদীতে ৩৬.৫ ডিগ্রি, ঢাকায় ৩৬, ময়মনসিংহে ৩৫ দশমিক ৫, চট্টগ্রামে ৩৫ দশমিক ৫, সিলেটে ৩৭ দশমিক ৩, রংপুরে ৩৬ দশমিক ৫, খুলনায় ৩৪ এবং বরিশালে ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন