শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ঈমানি দায়িত্ব

মুহাম্মদ জিয়াউল হক | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। বানের পানিতে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা প্রথমে ভেবে ছিল পানি হয়তো ঘরে উঠবে না। সেই ভেবে নিজ ঘরে থাকার নিস্ফল চেষ্টা করেছিল। ঘরে পানি দেখতে পেয়ে সেচে কমানো চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি। শুকনা খাবারের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঁচুতে রেখে দিয়ে ছিল। যাতে খাবারের সাময়িক সংকট মেটাতে পারে। তাও বিফলে গেল। অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে চাপা কষ্ট নিয়েই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মধ্যরাতে পানি বাড়তে থাকায় রাতের রাঁধারেই অনেককে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। সেখানেও বানের পানি চলে আসে। কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া বিষাক্ত প্রাণিদের আনাগোনার কারণে বাড়তি ভয়ও কাজ করছে। বানভাসি মানুষদের প্রতিটা মুহূর্ত আতঙ্কের মধ্যে অতিক্রম করতে হচ্ছে। ২১ জুন দৈনিক পত্রিকার নিউজ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে সারাদেশে বন্যায় ৩৬ জনের মৃত্যু: তারমধ্যে সিলেটেই ২২ জন।
এবারের বন্যায় বিশেষ করে সিলেটের অবস্থা খুবই সূচনীয়। সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক। ফলে যানবাহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পড়ে। পানিতে থৈই থৈই করতে থাকে পথঘাট। অনেকের ঘর-বাড়ি বানের পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমনও অঞ্চল আছে, একটি বাড়িও অবশিষ্ট নেই যেখানে গিয়ে বানভাসি মানুষগুলা একটু আশ্রয় নিবে। কারো উপার্জনের মাধ্যম ছিল গৃহপালিত পশু। সেগুলোও বানের পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মরে পানিতে ভাসতে থাকা অনেক গৃহপালিত পশুর চিত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গিয়েছে। যাদের পশুগুলো বেঁচে আছে, তারাও নিজেদের গবাদিপশু নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন। পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহে না থাকায় চরম খাবার সংকটে ভোগছেন। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশনের সমস্যাও প্রকট। অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করা যাচ্ছে না। ভাবা যায়, সেই জনপদের পানিবন্দি মানুষগুলো কী অবস্থ আছে! একেবারে অসহায় হয়ে পড়ছে এ মানুষগুলো। যাদের কষ্টের কোনো সীমা নইে।
মানুষ মানুষের জন্য। অন্যের দুঃখে দুঃখিত হবে। একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে আসবে এটাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা। বিশ^মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতকে পারস্পরিক সম্মান-মর্যাদা সহকারে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেই সাথে এ নির্দেশও দিয়েছেন পরস্পরে দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা ও অসুবিধার প্রতি লক্ষ রাখতে এবং সাধ্যমতো একে অন্যের প্রয়োজন পূরণ ও উপকার করতে উৎসাহিত করেছেন। বিপদগ্রস্থদের সাহায্য করাÑ ইসলাম ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষের বিপদে আজ যদি আমি এগিয়ে যায় তাহলে আমার বিপদে আল্লাহ সহায় হবেন। দুনিয়ায় অপর ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে আল্লাহও তাকে কিয়ামতের দিন মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারো প্রতি অত্যাচার করে না...। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের একটি কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের কষ্ট লাঘব করবেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৮৯৩।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একদা পথে এক ব্যক্তির খুবই তৃষ্ণা পেয়েছিল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নামল এবং পানি পান করে উঠে আসল। তখন দেখতে পেল, একটি কুকুর তৃষ্ণার জ¦ালায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে এবং তৃষ্ণা মেটাতে কাদামাটি খাচ্ছে। তখন লোকটি মনে মনে বলল; আমার যেমন ভীষণ তৃষ্ণা পেিেছল, এ কুকুরেরও ঠিক তেমনি তৃষ্ণা পেয়েছে। সে কূপে নেমে চামড়ার মোজা ভরে পানি নিয়ে এল এবং কুকুরকে পান করাল। ফলে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনÑ ইয়া রাসূলাল্লাহ! গবাদী পশুর ক্ষেত্রেও কি আমাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যেক প্রাণীতেই প্রতিদান-সওয়াব রয়েছে। সহীহ্ বুখারি, হাদিস ২৪৬৬। বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, গরু-ছাগলসহ গবাদিপশুদেরও কষ্ট হচ্ছে। পটুয়াখালিতে বনের বাঘ গাছে উঠে বসে আছে। মোটকথা নানামুখী সংকটে দুর্বিষহ সময় পার করছে। আজকে যে অঞ্চলের মানুষ গৃহহারা হয়েছেন। শেষ সম্বল ভিটেবাড়িটাও যাদের পানিতে ভসিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের সাহায্য-সহযোগীতা করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। হতে পারতো সেই ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে আমি আপনি অথবা আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজনও থাকতে পারতো। একজন মুমিন হিসেবে তাদের কষ্টে আমাদেরও ব্যাথিত হতে হবে। আমাদের উচিত নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে সামর্থানুযায়ী সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সব মুসলিম এক ব্যক্তিসত্তার মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীর তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরিই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ সহীহ মুসলিম, হাদিস ২৫৮৬।
সবাই যেন এক দেহ; আদর্শের এ ভ্রাতৃত্ব কোনো ধরনের সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতার দ্বারা আবদ্ধ নয়। কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন। যারা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে তারাদেরকে ‘শহীদ’ বলে অখ্যায়িত করেছেন। হযরত জাবের বিন আতিক রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমাদের নিকট শাহাদত কোনটি?’ তারা উত্তরে বললো, ‘আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আরো সাত শ্রেণির লোক শহীদদের মর্যাদা পাবে। ১. মহামারীতে মৃত ব্যক্তি। ২. পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ব্যক্তি। ৩. শ^াসকষ্ট রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তি। ৪. পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি। ৫. আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি। ৬. কোনো কিছু চাপা পরে মারা যাওয়া ব্যক্তি এবং প্রসব কষ্টে মৃত নারী শহীদ।’ আবু দাউদ: হাদিস ৩১১১।
আমরা দেখতে পেলাম বিভিন্ন সংস্থা নিজ উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বানভাসি মানুষের কাছে অতি দ্রুততার সাথে আলেমদের এগিয়ে আসা এবং তাদের সহযোগিতার বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। এ দুঃসময়ে একনিষ্ঠতার সাথে সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে যথাসময়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সারাদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন