প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে এখাতে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি সম্ভব। এছাড়াও তৈরি পোষাক খাতের সুবিধাসমূহ দেশের রফতানিমুখী অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতসমূহে প্রদানের উপর জোরারোপ করেন। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে ওষুধ খাতের রফতানি : কৌশল নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
সালমান এফ রহমান বলেন, ওষুধ খাতে আমাদের অর্জন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং দক্ষ মানব সম্পদের উপস্থিতির কারণে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, এ শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছে তাই আমাদেরকে আরো বেশি হারে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। এছাড়াও ওষুধ খাতে আগামীর চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে এ উপদেষ্টা বলেন, বিশ^ব্যাপী বেশি হারে বায়োলজিক্যাল ড্রাগ উৎপাদনের প্রবনতা আগামীতে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বর্তমানে দেশের ব্যবহৃত মোট এপিআই’র ১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে, তবে আরো বেশি হারে মূল্য সংযোজনের নিশ্চিতের বিষয়টি আমাদের জন্য অতীব জরুরী। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি ঔষধের প্রবেশাধিকারের বিষয়ে তিনি আশাবাদী এবং একবার এটা করা সম্ভব হলে ওষুধ খাতের বৈশি^ক ইমেজ তৈরিতে আরো কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশনের সময়ে করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মত বেশকিছু বৈশি^ক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, যার কারণে এবিষয়ে আমাদেরকে আরো সচেতন থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা বেশি থাকায় আমাদের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, তৈরি পোষাক রফতানিতে আমরা আমাদের সক্ষমতা দেখিয়েছি এবং ওষুধ খাত সহ অন্যান্য খাতে এ সক্ষমতা বজায়ে রাখতে পারলে দেশের রফতানি উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধি পাবে। এলডিসি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ হতে বেসরকারিখাতকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জ¦ালানি সঙ্কটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ খাতে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেসরকারিখাতসহ সকল জনগনকে আরো সচেতন ও সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধে বলেন, আমাদের অর্থনীতির জন্য ওষুধ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেটি আভ্যন্তরীন চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ উৎপাদন করতে সক্ষম, যার মূল্য প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ওষুধ খাতে রফতানির পরিমাণ ছিল ১৮৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের ওষুধ ও কেমিক্যাল খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১৯ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
ড. মোস্তাফিজ বলেন, গত অর্থবছর আমাদের ওষুধ খাত প্রায় ১ হাজার ৫০ দশমিক ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করছে, এমতাবস্থায় স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর আরো মনোযোগী হতে হবে। এছাড়াও গবেষণা ও উন্নয়নের উপর জোরারোপ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, এফডিআই সম্প্রসারণে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে যৌথ বিনিয়োগ আকর্ষনে গুরুত্বারোপ, কন্ট্রাক ম্যানুফ্যাকচারিং’কে উৎসাহিতকরণ, স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনের কাঁচামাল ও ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি আমদানি এবং উৎপাদিত এপিআই ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট ও উৎসে কর অব্যাহতির প্রস্তাব করেন, সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সংষ্কার ও প্রয়োজনে দ্রুতাতার সাথে নতুন নীতিমালা প্রয়েনের উপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, প্যটেন্ট আইন এবং ওষুধ নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের বাংলাদেশ ট্রিপস চুক্তি অনুসারে লাইসেন্সিং বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে আমাদের ওষুধ শিল্প সুবিধা ভোগ করতে পারে।
এসময় স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৮-১৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হতে পারে, যার ফলে আমাদের মোট রফতানি ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, এর মূল্য প্রায় ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক এ উত্তরণের পর ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী পণ্যের মেধাসত্ত্ব সুবিধা অব্যাহত থাকবে, তবে এ সময়কালের পর মেধাসত্ত্ব আইনের আওতায় বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত না থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের ওষুধখাতকে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে, সেই সাথে কমবে রফতানি। ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের স্বার্থে মেধাসত্ত্ব আইন গ্রহণের জন্য আমাদের বেসরকারিখাতকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং সেই সাথে সরকারের পক্ষ হতে প্রণোদনা প্রদানের করা একান্ত অপরিহার্য। এছাড়াও দেশীয় ওষুধ শিল্পের গবেষণা খাতের উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ড. এবিএম ফারুক এবং ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দেক হোসেন অংশগ্রহণ করেন। আলোচকবৃন্দ দ্রুততম সময়ে এপিআই পার্কের কার্যক্রম সম্পন্নকরণ, দীর্ঘমেয়াদী নীতিসহায়তা প্রদান, তৈরি পোষাকের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, ট্রিপস চুক্তির সময়কাল সম্প্রসারণে ডব্লিউটিও’র সাথে যোগযোগ স্থাপন এবং এশিয়ান অঞ্চলের বাজার সম্প্রসারণে প্রতি মনোনিবেশ বাড়ানোর আহ্বান জানান।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন