দুপুর হতে তখনো এক ঘণ্টা দেরি। গত ২১ জুলাই কাপড় ব্যবসায়ী মনির হোসেন স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে রিকশায় রামপুরা থেকে পল্টন যাচ্ছিলেন। শান্তিনগর এসে যানজটের মধ্যে পড়েন। হঠাৎ দু’দিক থেকে ৪/৫ জন হিজড়া এসে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে একজন মনির হোসেনের হাত ধরে টান দেয় এবং অপর একজন তার স্ত্রীর বোরকায় ধরে টানাটানি শুরু করে।
প্রথমে ২০ টাকার একটি নোট দিলেও পরে বাধ্য হয়ে ৫০ টাকা দিতে হয় মনির হোসেনকে। রাজধানীর পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতেও হিজড়াদের এমন অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এরা। হিজড়া হওয়ার কারণে এমনিতেই এরা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছে। আর এ সুযোগে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকেও পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে এদের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, ফার্মগেট, পরীবাগ ফুট ওভারব্রিজ, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে রাত হলেই পতিতাবৃত্তিতে নেমে পড়ে। এদের অধিকাংশই হিজড়া। অনেক হিজড়া পতিতা, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এসব এলাকায়। বিশেষ করে রাতে পথচারীরা রেহাই পায় না তাদের হাত থেকে। ফুটওভারব্রিজগুলোতে উঠলেই তাদের ডাকে সাড়া দিতে হবে, নইলে টানা-হেঁচড়া শুরু করে দেয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হিজড়াদের টাকা তোলা নতুন কিছু নয়। আগে মানুষ যা দিত, তা নিয়েই খুশি থাকত হিজড়ারা। কিন্তু এখন তাদের আচরণ বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করছে তারা। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়াও বেশ কঠিন।
ব্যবসায়ী মনির হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, অনেক সময় অনুনয় বিনয় করে ছাড় পাওয়া গেলেও মাঝেমধ্যেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে হিজড়ারা। প্রতিবাদ করলে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হতে হয় তাদের হাতে। অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়া এদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানদের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে চাঁদা নেয় হিজড়ারা।
তিনি অভিযোগ করেন, আমরা যারা রিকশায় চলাচল করি তাদের প্রায় সময়েই হিজড়াদের অত্যাচার সইতে হয়। পুলিশের সামনেই এরা চাঁদাবাজি ও সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময় নিরব ভূমিকা পালন করে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
গত শনিবার বেলা দুপুরের দিকে সচিবালয়ের সামনে রাস্তায় চাঁদা না পেয়ে ব্যস্ত সড়কে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ৮ জন হিজড়া। এতে বেকায়দায় পড়েন জরুরি প্রয়োজনে প্রাইভেটকার নিয়ে বের হওয়া ব্যক্তি। প্রকাশ্যে এমন ঘটনায় তিনি অসহায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, এটা তো চাঁদাবাজির মতো জোর করে টাকা দাবি করা। টাকা না দিলে হিজড়ারা হুঁমকি দিয়ে বলে, ‘টাকা না দিলে পোশাক খুলে ফেলব’। তখন আমরা লজ্জাজনক পরিস্থিতি এড়াতে তাকে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।
হাইকোর্টের সিনিয়র এডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ২০১৩ সালে এদের তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তখন থেকেই এদের দায়-দায়িত্বে বিষয়টিও এসেছে। এখন প্রশাসনের উচিত চাঁদাবাজি বা অন্য কোন অপরাধ করলে আইনের আওয়ায় আনা। হিজড়াদের বাড়াবাড়ি থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রশাসনের বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সমাজসেবা অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। বাস্তবে এ সংখ্যা চার গুণেরও বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যাদের বেশিরভাগ অবস্থান করেন ঢাকায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমাজসেবা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকায় কত হিজড়া আছে তার পরিসংখ্যান সেভাবে নেই। কিন্তু নানাভাবে হিজড়া সেজে তারাও নিজেদের হিজড়া দাবি করে আসছে। এক্ষেত্রে সংখ্যা আরও বাড়বে।
গত শনিবার মতিঝলে কথা হয় ব্যবসায়ী সোহেল রানার সাথে। তিনি জানিয়েছেন, রাজধানীতে বাসে যারা যাতায়ত করেন তাদের প্রতিদিনই হিজড়াদের খপ্পরে পড়তে হয়। একে তো বাসের ভাড়া দিতে হয়, তারপর এদের চাঁদাবাজি। আমাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পরে বাসায় ঢুকে জোর করে ১১ হাজার টাকা নিয়েছে হিজড়ারা। টাকা দেয়ার আগ পর্যন্ত তাদের যে আচরণ ছিল তা মনে পড়ল এখনও কষ্ট লাগে।
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা কলিম উদ্দিন জানান, ১৫ দিন আগে তার বোনের বাচ্চা হওয়ার পর বেড়াতে এসেছিলেন বাসায়। সেখানে খবর পেয়ে হিজড়ারা হানা দেয়। প্রায় তিন ঘণ্টা বাসায় তাণ্ডব চালিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা আদায় করে ছাড়ে। তিনি জানান, বিভিন্ন বাসা-বাড়ির দারোয়ানদের সঙ্গে হিজড়াদের যোগসাজস থাকে। কোনো বাসায় বাচ্চা হলে দারোয়ানরাই মূলত হিজড়াদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। এক্ষেত্রে দারোয়ানরাও ভাগ পেয়ে থাকে।
গত এক সপ্তাহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ট্রাফিক সঙ্কেতে যানবাহন থামার পর হিজড়ারা সামনে এসে দাঁড়ালে যাত্রীদের কিছু করার থাকে না। তাদের সঙ্গে তর্ক করলে যাত্রীদের আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, হিজড়াদের একটি দল কাকরাইল এলাকায় সিগন্যাল পড়লেই দৌড়ে এসে যানবাহনে থাকা যাত্রীদের কাছে টাকা দাবি করছে, না দিলে যাত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। অধিকাংশ মানুষের অভিযোগ, লোকাল বাসগুলোতে এমন চাঁদাবাজির সঙ্গে হেলপার এবং চালকরাও জড়িত। ‘গেটলক সার্ভিস’ বলা হলেও গেট খুলে রাখায় হিজড়ারা বাসে ওঠে চাঁদাবাজির সুযোগ পায়।
হাতিরঝিলে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে আসা লিংকন নামে এক ব্যাক্তি জানান, হিজড়াদের কয়েকটি দল এখানে নিয়মিত চাঁদা তোলে। এর ভাগ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও থানা পুলিশ থেকে থেকে শুরু করে অনেক স্তরে বাটায়োরা হয়। এদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এক ধরনের অসহায় হয়েই হিজড়াদের টাকা দিতে হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, কাউকে হয়রানি বা রাস্তায় চাঁদাবাজি করার কোন অধিকার হিজড়াদের নেই। এদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আমরা হিজড়াদের কার্যক্রম নজরদারি করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন