প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন গোটা মানবজাতির অনুসরণীয় জীবনাদর্শ। তিনি ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী। মানুষের সাথে খুব সুন্দরভাবে কথা বলতেন। তিনি সবসময় স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। তিনি যখন বিশেষ কোনো কথা বলতেন তখন সেটা মানুষের বুঝার সুবিধার জন্য তিনবার বলতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন কথা তিনবার বলতেন, যাতে (শ্রোতারা) ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলনে তিনি ছিলেন আরব অনারবের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি। তিনি সবসময় মুচকি হাসি নিয়ে কথা বলতেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এবং প্রফুল্লচিত্তে থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমার ভাইয়ের দিকে মুচকি হাসি নিয়ে তাকানোটাও একটা সৎ কাজ। তাঁর জীবনে নবুওয়াতের কঠিন জিম্মাদারির বোঝাকে নিজের মুচকি হাসিতে সহনীয় করে নিতেন। সাহাবায়ে কেরামগণের সাথে মুচকি হাসিতে হৃদয়ের গভীরে আসন করে নিতেন। এমনকি তিনি তাদের সাথে অকৃত্রিম রসিকতাও করতেন। যার কারণে সাহাবীদের হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যেত। তিনি হাস্যরসাত্মক কথা বলে মজলিশে আনন্দের মৃদু ঝরনা বয়ে দিতেন। তবে তিনি এক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতেন এবং সীমার মধ্যে থাকতেন। তাঁর কৌতুকের মাধ্যমে কাউকে কষ্ট কিংবা নিচু করতেন না। আবার এরকমও করতেননা, যার ফলে সবাই হাসির সীমা অতিক্রম করে। একবার প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণী হযরত আয়েশা (রা.) কে প্রশ্ন করা হলো যে, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কখনো হাস্য-রসিকতা করতেন? মা আয়েশা রা. উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, করতেন তবে যত্রতত্র নয়। স্থান-কাল- পাত্র ও সম্বোর্ধিত ব্যক্তিটির যোগ্যতানুসারে করতেন।
তিনি কৌতুক করে কথা বলার ক্ষেত্রে সবসময় সত্য কথাই বলতেন। মিথ্যা কথা বলে মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করতেন না। একবার আবু হুরায়রা রা. অবাক হয়ে বললেন, আপনি দেখি রসিকতাও করেন’ রাসুলে করিম বললেন, হ্যাঁ, তা করি। তবে আমি কোন অন্যায় এবং অসত্য কথা বলিনা। হাদিসের ভাষায় আরো কিছু রসিকতা শুনা যাক তাহলে। হযরত আনাস ( রা.) এর বর্ণনায়, একবার জনৈক ব্যক্তি মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে সওয়ার উপযোগী একটা উটের জন্য আবেদন করলো। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে উটের একটা বাচ্চা দান করবো। লোকটি হতাশ হয়ে বললো, হুজুর, আমি উটের বাচ্চা নিয়ে কি করবো? প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, প্রত্যেক উটই কোন না কোন উটনীর বাচ্চা হয়ে থাকে। একদিন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মামার বোন তোমার কী হয়? সরলমনা লোকটি মাথা নিচু করে ভাবতে শুরু করলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, আশ্চর্য, তুমি তোমার মাকেই ভুলে গেলে?
শুধু কি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসিকতা করতেন? সাহাবায়ে কেরাম রাসুলের সাথে রসিকতা করতেন না? করলে সেটা কিভাবে নিতেন! তিনি সাহাবায়ে কেরামগণের রসিকতাগুলোও খুব সহজভাবে নিতেন। যেমন দেখুন-হযরত আওফ ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, তাবুক যুদ্ধের সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ছোট একটা তাবুতে অবস্থান করছিলেন।আমি তাবুর সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভিতরে এসো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি সম্পূর্ণ ঢুকে যাবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ সম্পূর্ণ। একবার হযরত আবু যর গিফারী (রা.) মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, শুনেছি, দাজ্জাল যখন বের হবে তখন নাকি পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। মানুষকে গোমরাহ করার জন্য তারা খানার নিমন্ত্রণ করবে। তার দস্তরখানায় নানারকমের খাবার থাকবে। আমার ইচ্ছে আমি যদি সে যুগে জীবিত থাকি তাহলে দাজ্জালের নিমন্ত্রণে গিয়ে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে কেটে পড়বো।এ কথা শুনে নবীজি মুচকি হেসে বললেন, তুমি যদি ঐ যুগে জীবিত থাকো তবুও দাজ্জালের নিমন্ত্রণ খাওয়ার প্রয়োজন হবেনা। আল্লাহ তা’আলা তোমাকে দাজ্জালের খানার মুখাপেক্ষী করবেনা।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবীদের সাথে বসে খেজুর খাচ্ছিলেন।হযরত আলীও ওই মজলিশে বসে খেজুর খাচ্ছিলেন। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ক’জন সাহাবী খেজুরের বীচি গুলো হযরত আলী রা. এর সামনে রেখে দিচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসিকতা করে বললেন, বীচি দেখে অনুমান করা যায়, কে সবচেয়ে বেশি খেজুর খেয়েছে। তখন হযরত আলী রা. হেসে বললেন, এতে এটাও অনুমান করা যায় কোন মানুষটি বীচি বাদ দিয়ে খেজুর খেয়েছে আর কোন মানুষটি বীচিসহ খেজুর খেয়েছে।
একবার হযরত সোহাইব ( রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন তিনি খেজুর খাচ্ছেন বসে বসে। হযরত সোহাইব ও খেজুর খেতে লাগলেন। রাসুল পাক বললেন, তোমার চোখ উঠেছে আর তুমি খেজুর খাওয়া শুরু করেছো! হযরত সোবাইব উত্তর দিলেন, হুযুর আমার একটা চোখ একটু ভালো আছে। আর ভালোটা দিয়ে খেজুর খাওয়া চলবে। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা শুনে মুচকি হাসলেন। একবার এক সাহাবী রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হুজুর, আমি আজকে একটি মূর্তি থেকে খুব উপকার পেয়েছি। তাঁর কথা শুনে সাহাবায়ে কেরামগণ বিস্ময়ে সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। বক্তা শ্রোতাদের মনোভাব আঁচ করতে পেরে বিষয়টা খোলাসা করে বললেন, ইয়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি দীর্ঘ সফরে বের হওয়ার সময় ছাতু দিয়ে একটা মূর্তি তৈরি করে রাখি। সফরকালে আমার খাবার শেষ হয়ে গেলে আমি এ মূর্তিটি চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন