পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেছেন, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় তিন বছর মেয়াদী সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে ৩য় বারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে বাঘের জরিপ পরিচালনা, বাঘের শিকার প্রাণী- হরিণ ও শুকরের সংখ্যা গণনা, সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন ৬০ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের ফেন্সিং বা বেষ্টনী তৈরিসহ বাঘ সংরক্ষণ ও গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে। মন্ত্রী বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
গতকাল বিশ্ব বাঘ দিবস ২০২২ উপলক্ষে বন অধিদপ্তরে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে সরকারি বাসভবন হতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বনমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করার জন্য তৈরি ঘোষণাপত্রের আলোকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষার দায়িত্ব সবার, যা সময়োপযোগী বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ সালে পরিচালিত জরিপের তথ্যানুযায়ী আমাদের সুন্দরবন অংশে রয়েছে প্রায় ১১৪টি বেঙ্গল টাইগার এবং ২০২০-২০২১ সালের জরিপ অনুসারে ভারতের সুন্দরবন অংশে আছে প্রায় ৯৬টি বাঘ।
আইইউসিএন গ্রোবাল স্পিশিজ রেড লিস্ট-২০২০ অনুসারে, বিশ্বে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৪৮৫টি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সারাবিশ্বে বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে বেঙ্গল টাইগার বিশ্বে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এবং অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন।
খুলনা থেকে ডি এম রেজা সোহাগ জানান, রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের অলংকার। সুন্দরবনের মূল্যবান বনজ সম্পদ রক্ষায় যুগের পর যুগ ধরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিরব রক্ষকের কাজ করে চলেছে। চোরা শিকারীদের অপতৎপরতা, বনের নদনদী ও খালে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, খাদ্যের অভাবসহ নানা কারণে একটা সময় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যায়। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশনায় বাঘ রক্ষায় বনবিভাগের নানামুখি পদক্ষেপে আবারও বাঘের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ২০১৫ সালের জরিপে বাঘ ছিল ১০৬ টি। ২০১৮ সালের জরিপে বেড়ে তা দাঁড়ায় ১১৪ টিতে। বনবিভাগের ধারণা বাঘের সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে আগামী অক্টোবর-নভেম্বর থেকে সুন্দরবনে বাঘ জরিপ শুরু হচ্ছে। চলমান জরিপ শেষে ২০২৫ সালে জানা যাবে সুন্দরবনে কতটি বাঘ রয়েছে।
সুন্দরবন-পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বন বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে আমরা সুন্দরবনে টহল জোরদার করেছি। যার ফলে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের তৎপরতা কমেছে। সর্বশেষ করোনা মহামারিতে একসঙ্গে দীর্ঘদিন দেয়া লকডাউনে সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ ছিল। তখন সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠেছে। এ সময়ে বাঘেরাও তাদের ইচ্ছেমতো বনে বিচরণ করেছে। প্রজননও ঘটেছে। তাই আশা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।
তিনি আরও জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সুন্দরবনে ৪ বছর পর শুরু হচ্ছে বাঘ শুমারি। এ বছর অক্টোবর-নভেম্বরে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে শুরু হয়ে এ গণনা চলবে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। ৩ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। বনের স্থল ভাগের ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার এই জরিপের ফল জানা যাবে ২০২৫ সাল নাগাদ। এ প্রকল্পের আওতায় বাঘের মূল খাদ্য বনের হরিণ ও শূকরের সংখ্যাও গননা করা হবে।
চোরা শিকারীদের বাঘ শিকারের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনের অন্তত ৪৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আটটি বাঘের বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। চোরা শিকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ১৩টি বাঘ। লোকালয়ে আসায় গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে পাঁচটি বাঘের। ২০০৯ সালে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় সিডরে মৃত্যু হয়েছে একটি বাঘের। বর্তমানে বনে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। চোরা শিকারীদের তৎপরতা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাঘ হত্যার সংখ্যা প্রায় শুন্যে নেমে এসেছে। করোনা মহামারি থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক বার সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় বাঘ ও বাঘের বাচ্চা দেখেছেন বনরক্ষী, স্থানীয় বাসিন্দা ও দর্শণার্থীরা। এসব কারণে আমরা ধারণা করছি, সুন্দরবনে এবার বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
বাগেরহাট থেকে এস এম সামছুর রহমান জানান, সারা দেশের মত বাগেরহাটের সুন্দরবন ঘেষা মোংলা ও শরণখোলায়ও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ আছে ১১৪টি। যদিও ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত বয়সের কারণে মারা গেছে কয়েকটি বাঘ। একই সাথে চোরা শিকারী ও পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বাঘের চামড়াসহ অংগ-প্রত্যঙ্গ।
পরিবেশবাদীদের দাবী, চোরা শিকারীদের দৌরাত্ত, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ নানা প্রতিকূলতার কারনে হুমকীর মুখে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারা বলছেন, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। বন বিভাগ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমিকে তাদের জন্য সম্পূর্ন নিরাপদ করতে পারেনি। সুন্দরবনকে বন্যপ্রাণীদের জন্য নিরাপদ করা গেলে দ্রুত বাঘের সংখ্যা বাড়বে। আর বনবিভাগ বলছে, সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষনে সরকারী ভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
সুন্দরবন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, বাঘ একটি নিদৃষ্ট গন্ডির মধ্যে চলাচল করে। যখন বাঘটির বয়স হয়ে যায় তখন অন্য বাঘ এটিকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে অন্য দিকে চলে যায়। সেখান থেকেও তাকে তাড়িয়ে দিলে সে লোকালয়ে চলে আসতে পারে। তিনি সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বনরক্ষীরা বাঘের উপস্থিতি টের পেয়েছে বলে জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা কমিটির আহবায়ক নুর আলম বলেন, ২০ বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এখন আছে মাত্র ১১৪টি। সেখান থেকেও কয়েকটি মারা গেছে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, চোরা শিকারীদের দৌরাত্ব, বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন নিরাপদ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারনে বাঘের সংখ্যা কমেছে। সুন্দরবানের পাশে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্পকারখানাসহ সুন্দরবন বিধ্বংসি সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে সান্তানুর রহমান খোকন জানান, শরণখোলায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে গতকাল সকালে সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা বাজারের র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ শরণখোলা রেঞ্জের আয়োজনে স্থানীয় প্রদীপন ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠিানের আয়োজন করে। শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নুর ই আলম সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, শরনখোলা থানার অফিসার ইন চার্জ মো. ইকরাম হোসেন, সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, শরনখোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটন প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন