ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া থেকে বিভিন্ন রকম সবজি আনা হয় রাজধানীতে। এর মধ্যে রয়েছে ঢ্যাঁড়স, পটোল, শিম, টমেটো, কপি ও বেগুন। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আনা এসব সবজি দেখতে মনকাড়া হলেও কতটা নিরাপদ, তা জানতে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর বাইরেও মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ থেকে প্রচুর সবজি ঢাকায় আসে। বাণিজ্যিক ভিক্তিতে এসব সবজি বড় করায় নিয়মিত সার ও কীটনাশক ওষুধ তথা বিষ স্প্রে করা হয়। এসব সজজি প্রতিদিন খাচ্ছেন ঢাকার মানুষ। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে এসব সবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে।
কেরানিগঞ্জে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কলাতিয়ার মিরাস আসামদিপুর গ্রামের কৃষক আমিনুর রহমান তার ঢ্যাঁড়স ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছিলেন। হেপিং-১০ ডব্লিউপিজি ও করলাক্স-২৫ ইসি পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে মেশিনে ভরেন তিনি। এরপর তিনি তা ঢ্যাঁড়স ক্ষেতে স্প্রে করেন।
হেপিং কীটনাশকের প্যাকেটের গায়ে লাল কালি দিয়ে লেখা, ‘হেপিং-১০ ডব্লিউপিজি স্প্রে করার পর ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত খেতে গৃহপালিত পশুপাখি প্রবেশ করতে দেবেন না এবং খাওয়া বা বিক্রির জন্য তুলবেন না।’ আরও লেখা রয়েছে, ‘খালি গায়ে বা বাতাসের বিপরীতে স্প্রে করবেন না। স্প্রে করার সময় শরীর ও মুখমণ্ডল ঢেকে রাখবেন।’
কিন্তু কৃষক আমির হোসেনের নাকেমুখে কোনো কাপড় নেই। এ ছাড়া তিনি বলেন, ‘ক্ষেতে বালাইনাশক দিলাম। আগামীকাল সকালে সাত-আটজন শ্রমিক আসবে। তারা ঢ্যাঁড়স তুলবে। পরে তা বাজারে নিমু।’
কৃষক আমিনুর আরো বলেন, তিনি ২৫ বছর ধরে সবজির আবাদ করছেন। জমিতে কোম্পানির লোকজন এসে বালাইনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। সরকারের কৃষি বিভাগের কেউ কখনো আসেন না। একই গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী ৩০ বছর ধরে সবজির আবাদ করছেন। তিনি বলেন, সবজির চাষ শেষে জমি আবার চাষযোগ্য করতে ঘাস ও অন্য গাছপালা ধ্বংস করতে একধরনের বিষ দেওয়া হয়। এই বিষ দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে পুরো জমির ঘাস ও অন্য গাছপালা পুড়ে যায়। মাত্র ২০০ টাকার বিষ দিলেই জমি পরিষ্কার হয়ে যায়। তার জমিতে দেখা যায়, পুরোনো সবজির গাছ ও ঘাস যেন আগুনে পুড়ে গেছে। মাটিতেও দেখা গেছে পোড়ার দাগ।
বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, বাজারের বিভিন্ন সবজির নমুনায় শতকরা ৮ থেকে ১২ শতাংশে বালাইনাশকের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (বালাইনাশক ও বিষতত্ত্ব বিভাগ) ড. মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান বলেন, ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনে কৃষকেরা মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৭ দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ২০ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এরপর সবজি তুলতে হয়।
নিয়ম মেনে বালাইনাশক প্রয়োগ না করায় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই সবজি তুলে তা খাওয়ায় মানুষ নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ও পুষ্টিবিদ বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, বালাইনাশক প্রয়োগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন রয়েছে কখন প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োগের কত দিন পর তা তোলা বা বাজারে নেওয়া যাবে, এসব নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ কৃষকই মানেন না। তাই এ ধরনের সবজি খেয়ে মানুষ কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মানসিক সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের ফলমূল নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত করতে সরকার গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (গ্যাপ) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাপ বাস্তবায়ন করা গেলে বিদেশে সবজি রপ্তানি বহু গুণ বাড়বে। একই সঙ্গে এটি চালু করা গেলে মানুষ নিরাপদে সবজি ও ফলমূল গ্রহণ করতে পারবে। দেশের সব ধরনের খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত রাখার প্রত্যয়ে দেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কয়েকটি বিধি-প্রবিধি প্রণয়ন করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষ নিরাপদ খাদ্য প্রবিধানমালা জারি করে।
জানতে চাইলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, শাকসবজিতে বালাইনাশক দেখার দায়িত্বে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের তিনজন কর্মকর্তা দায়িত্বে রয়েছেন। আর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের রয়েছে জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন