নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি নারী ও শিশুদের রক্ষাকবচ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নিরীহ মানুষদের ফাঁসাতে আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে অহরহ। সুবিধাভোগী দুষ্টচক্র এ আইনের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মিথ্যা মামলা দায়েরের ফলে প্রকৃত ভুক্তভোগী বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায় বিচার থেকে। এ আইনে দায়ের করা মামলার বিচারে পরে অধিকাংশই ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হয়। আইনজ্ঞদের মতে, ভিন্ন বিষয়ে বিরোধ বাঁধলেও মামলা দায়ের করা হচ্ছে নারী নির্যাতন আইনে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সুবিধাভোগী চক্র আইনের ফাঁক-ফোঁকর ব্যবহার করছে।
কেস স্ট্যাডি (এক):
ঘটনার শুরু ২০১১ সালে। কলেজে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন সাকিল ইসলাম রাব্বি। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর। থাকতেন ঢাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে। ২০১১ সালের ৮ নভেম্বর গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যান। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ এলাকা তোলপাড়। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে রাব্বি তার পাশের বাড়ির মাদ্রাসা পড়ুয়া কিশোরীকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে। ওই সময় তার আপন চাচাসহ ২জন আপত্তিকর দৃশ্যের ভিডিও’ ধারণ করে। মিডিয়াতেও ব্যাপক তোলপাড় হয় ঘটনাটি। বিশেষ করে ধর্ষণ চেষ্টার অপমান সইতে না পেরে মেয়েটির আত্মহত্যার চেষ্টার খবরে। এ ঘটনায় ৩ জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১১/৯৯৪)(খ)/৩০ ধারায় উজিরপুর থানায় একটি মামলা হয়। পরে বরিশালের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল মামলা নং-২৬৭/২০১২। তখন ১৭ বছরের রাব্বি ভিলেজ পলিট্রিক্সের কিছুই বুঝতে পারেনি। আগাম জামিন নিতে গিয়ে জেলে যেতে হয় রাব্বিকে। হয়রানির শিকার হন মামলার অন্য আসামিরাও। দীর্ঘ ৮ বছর পর পুলিশের সঠিক তদন্ত ও আদালতে আইনজীবীর জেরার মুখে সত্য প্রকাশ পায়। রাব্বির মরহুম (তখন জীবীত) দাদার সঙ্গে কথিত ধর্ষিতার পরিবারের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ওই বিরোধকে কেন্দ্র করে কিশোরীর আপন ভাই নবীনের পরামর্শে তখন রাব্বি ও তার চাচা এরশাদ হাওলাদারকে আসামি করে ওই মামলাটি দায়ের করা হয়। ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট আদালত ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ আখ্যা দিয়ে আসামিদের বেকসুর খালাস দেন। এই মিথ্যা মামলার কারণে শেষ হয়ে গেছে রাব্বির বিদেশে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন।
কেস স্ট্যাডি (দুই):
রাজধানীর খিলগাঁও থানায় ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/৩) এর ৭/৩০ ধারায় একটি মামলা (মামলা নং-২০) রুজু হয়। মামলার বাদী জনৈক আলী আহম্মদ এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার ২ দিন আগে ৮ ডিসেম্বর ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী বাসায় ফিরছিলেন। পথে তার স্ত্রী বাজার করার জন্য পথে নেমে যান। এর কিছুক্ষণ পর বেলা দেড়টার দিকে জনৈক আবু তাহের তার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মামলায় আবু তাহেরের বাবা এমারত হাওলাদার ও মা শিনা বেগমকেও আসামি করা হয়। দুই দিন পর ১২ ডিসেম্বর পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় ভিকটিমকে। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ মামলার চার্জশিট দেয় পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনাল-৩ এ বিচারের জন্য বদলি হয় মামলাটি। (নতুন মামলা নং ৩৪৬/২০) এর পর চার্জ শুনানর জন্য যথাক্রমে ২৮/০১/২১, ২০/৫/২১ তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পরে বিগত ২৮ নভেম্বর ২১ তারিখে মামলার বিজ্ঞ কৌশলী তার চুলচেরা বিশ্লেষনমূলক শুনানীর মাধ্যমে মামলাটি মিথ্যা প্রমান করতে সক্ষম হন। শুনানী মঞ্জুর হয় এবং আসামি ওই মামলার দায় থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। যাহার মাধ্যমে মামলাটি মিথ্যা প্রমানিত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলার বাদী আসামির আপন মামা। বোন ও বোন ভগ্নিপতির সাথে তার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিল। এ বিরোধ থেকেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দায়ের করা হয় এ মামলা।
কেস স্ট্যাডি-(তিন):
২০১০ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা হয়। ফারজানা ইসলাম নামে এক তরুণী এ মামলাটির বাদী। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, হাজারীবাগের একটি এলাকা থেকে রিকশায় বাসায় ফেরার পথে তার ওড়না ধরে টানাটানি এবং রিকশা থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে ইমরান নামে এক যুবক। ওই মামলায় ইমরান গ্রেপ্তার হয়ে ৩ মাস কারাভোগ করেন। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন মেলে যুবকের। চার্জশিট শেষে মামলাটি নারী ও শিশু ট্রাইবুনাল-৪ এ নতুন মামলা হিসেবে (নং-৩২২/১০) নম্বর পড়ে। দীর্ঘ শুনানী শেষে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারী মামলাটি ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হয়। ইমরান বেকসুর খালাস পান। ওই মামলার আইনজীবী বলেছেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হয়েছে ইমরানকে। এ রকম মিথ্যা মামলার দৃষ্টান্ত বহু রয়েছে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল সূত্র জানায়, এ গত তিন ৮ নম্বর আদালতে মাসে ১০৮৮টি মামলার রায় হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ টি মামলায় নারী নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
মিথ্যা মামলা সম্পর্কে ঢাকা জেলা আদালতের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম এই প্রতিবেদককে বলেন, জনস্বার্থে এবং সময়ের প্রয়োজনে সরকার কোনো বিষয়ে আইন প্রনয়ন করেন। আবার প্রয়োজনে সেই আইনের সংশোধন কিংবা ধারা সংযোজন করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনটিও তেমন। সময়ের প্রয়োজনেই এটির বিভিন্ন ধারা উপধারা সংযোজন হয়েছে। কিন্তু এখন নারী ও শিশু নির্যাতনের অনেক মামলাই আদালতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। ফলে আসামিরা খালাস পায়।একইভাবে অনেক নিরপরাধও হয়রানির শিকার হন। তবে এ আইনের মামলায় যদি বোঝা যায় যে, মামলাটি প্রতারণামূলক সে ক্ষেত্রে বিচারক এ আইনের ১৭ ধারায় বাদীর বিরুদ্ধেও চার্জ গঠন করতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আসামিরা এ সুবিধাটা খুবই কম নিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিশেষত: ১১ (গ) ধারার (যৌতুক চেয়ে স্ত্রীকে মারধর) দায়ের মামলার সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে বাদী পক্ষ। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ১১ (গ) ধারা থেকে আপোষযোগ্য করায় বাদী ও বিবাদীরা উভয়েই উপকৃত হচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট রেজাউল ফিরোজ রিন্টু এ বিষয়ে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কিছু মামলা করা অত্যন্ত সহজ। যাতে কোনো ধরণের আলামত, তথ্য প্রমান কিংবা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয় না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সুবিধাভোগী চক্র কৌশলে আইনের অপপ্রয়োগ করছে। আইনটির ১০ ধারায় (শ্লীলতাহানী) বলা আছে, কোন পুরুষ যদি কোন নারীর শরীর স্পর্শকাতর অঙ্গ স্পর্শ করে সে ক্ষেত্রে আইনে অপরাধ হয়। এতে মৌখিক সাক্ষীই যথেষ্ট। একইভাবে অত্র আইনের ৯ (৪) (খ) ধারায় ধর্ষণের চেষ্টার অপরাধের বিষয়ে বলা আছে, অত্র ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরে মৌখিক সাক্ষীই যথেষ্ট। দুষ্টচক্র এ সুবিধাটাই নিয়ে থাকে। এ ধরণের মামলা দায়েরের পর বিচার কিংবা রায়ের আগে পর্যন্ত আসামিরা হয়রানির শিকার হন।
এদিকে আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০০ সালে প্রথমে নারী নির্যাতন আইন প্রবর্তন হয়। পরে ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময় সংশোধন হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ (গ) (খ) ধারার মামলা থানার চেয়ে ট্রাইবুনালে বেশি রুজু হয়। ট্রাইব্যুনাল মামলাগুলো বেশিরভাগই জুডিশিয়াল ইনকোয়ারির জন্য পাঠিয়ে দেয়। রিপোর্ট প্রাপ্তি সাপেক্ষে অপরাধ আমলে নেয়া হয়। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ছাড়া অন্যান্য মামলাগুলো সাধারণত পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক তদন্ত হয়। বেশিরভাগ মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মামলাগুলো সাক্ষীর পর্যায়ে এলে বাদী পক্ষের সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। অনেক মামলায় বাদী পক্ষের সাক্ষী সাক্ষ্য না দেয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যান। একইভাবে সাক্ষীর অভাবে প্রকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচার পান না।
মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিযোগ নারী নির্যাতন হলেও ভিন্ন ধরণের বিরোধ থেকে অসাধুচক্র প্রতারণামূলকভাবে মিথ্যা মামলা করে। যদিও প্রাথমিক অনুসন্ধান ছাড়া থানা-পুলিশ এখন নির্যাতন এবং ধর্ষণের মামলা গ্রহণ করছে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি নারী ও শিশু নির্যাতন,ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েই যায় এবং আদালত সেটি ‘এজাহার’ হিসেবে গণ্য করে এবং পুলিশকে তদন্ত করতে দেয় তাহলেই আসামির রক্ষা নেই। তিনি দোষী কিংবা নির্দোষ যা-ই হোন, গ্রেফতারের পর জামিন পান না সহজে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর কারাভোগ করলেও পাল্টা মামলা দায়ের করে আইনি লড়াই পরিচালনার মতো মানসিক শক্তি ও আর্থিক সঙ্গতি থাকে না অনেকের। এতে বেঁচে যায় মিথ্যা মামলার বাদী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন