অসময়ে বন্যা হাওরাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে খরায় পুড়ছে দেশ। এতে ব্যহত হচ্ছে আমন চাষ। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি দেশে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কট। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে জমিতে সেচ বিঘ্নিত হবে এবং উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে গ্যাস সঙ্কটের কারণে চাহিদানুযায়ী সার উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস সংকটের কারণে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা ও যমুনা সার কারখানার বন্ধ রয়েছে। সেই সাথে ভর্তুকি কমানোর কথা বলে ইউরিয়া সারের দামও কেজিতে ৬ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সার সঙ্কট এবং বিদ্যুৎ সঙ্কট কৃষিতে বড় ধরনের নেতি বাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জুড়ে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর ঢেউ এদেশেও আছড়ে পড়ছে। যুদ্ধের অজুহাতে আটা, ময়দা, চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেওয়ায় চাহিদা মত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাই সরকার নানাভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের পথ বেছে নিয়েছে। এতে সাময়িক কিছুটা সুফল মিললেও কৃষি খাতে অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনা মহামারিকালে কৃষি উৎপাদন দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এখন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কটের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার ছোবল থেকে বাঁচতে দেশের কৃষি উৎপাদনের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের ফলে সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ভর্তুর্কি কমানোর জন্য সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে আমন এবং ইরি চাষে নেতি বাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে ইরি চাষে যদি সেচ সঙ্কট দেখা দেয় তাহলে উৎপাদনে লক্ষমাত্র অর্জন সম্ভব হবে না। বন্যায় বোরোতে অনেক ক্ষতি হয়েছে এখন যদি আমন ও ইরি চাষে উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জন করা না যায় তাহলে খাদ্য সঙ্কটের শঙ্কাতো থেকেই যায়।
ভর্তুকি কমাতে সরকার গতকাল ইউরিয়া সারে দাম কেজি প্রতি ৬ টাকা বাড়িয়েছে। এতে দেশে ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ১৪ টাকা থেকে ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে এক কেজি ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা পুন:নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্ধিত মূল্য ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, ইউরিয়া সারের ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এবং চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশেও দাম বাড়ানো হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিকেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রতিকেজি ইউরিয়া সারের ভর্তুকি ছিল মাত্র ১৫ টাকা। অন্যদিকে, বিগত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩-৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সারে সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আমন মৌসুমে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ৬ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, বিপরীতে বর্তমানে মজুত রয়েছে ৭ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন, যা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ১ লাখ টন বেশি। অন্যান্য সার যেমন টিএসপির আমন মৌসুমে চাহিদা ১ লাখ ১৯ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৩ লাখ ৯ হাজার টন, ডিএপির চাহিদা ২ লাখ ২৫ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৬ লাখ ৩৪ হাজার টন এবং এমওপির চাহিদা ১ লাখ ৩৭ হাজার টন, বিপরীতে মজুত রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টন।
তবে স্থানীয় সারের ডিলাররা মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যের সত্যতা পাচ্ছে না। গত এক মাস যাবৎ ইউরিয়া সারের কিছুটা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার জানান। তিনি বলেন, গত এক মাস যাবত প্রয়োজন মত ইউরিয়া সার পাচ্ছেন না। যমুনা সার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে ১০০ টন সারের চাহিদা দিলে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টন। তার মতে যদি দ্রুত সার উৎপাদন শুরু না করা হয় তাহলে এ সঙ্কট তীব্র হয়ে দেখা দেবে।
দেশে মোট ৭টি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে উৎপাদন বন্ধ। অন্য কারখানাগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদনে যেতে পারছে না। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার এ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন। কিন্তু বর্তমানে এ কারখানা বছরে ২লাখ টনের মত সার উৎপাদন করছে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,৮১,০০০ মেট্রিক টন। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে অর্ধেকেরও কম। ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটিড ও ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডেও কখনো উৎপাদন চালু থাকে কখনো বন্ধ। এতে এ কম্পানিগুলোতেও সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম উৎপদন হচ্ছে।
অন্যদিকে গ্যাসের সংকটের কারণে গত ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড। কবে চালু হবে তা নিয়ে কারখানার (সিইউএফএল) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন এখানে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সিএফইউএলের বাণিজ্যিক শাখার সূত্রমতে, প্রায় ৩৮ বছরের পুরোনো এই সার কারখানার বর্তমানে ইউরিয়া সার উৎপাদনের ক্ষমতা দৈনিক ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। কিন্তু কারখানাটি উৎপাদন করে থাকে দৈনিক ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। বর্তমানে এই কারখানায় উৎপাদিত প্রতি টন ইউরিয়া সারের মূল্য ১৪ হাজার টাকা।
সিইউএফএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মইনুল হক বলেন,‘সিইউএফএল মূলত গ্যাসের সংকটের কারণেই বন্ধ রয়েছে গত ১৯ জুলাই থেকে। কবে চালু হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমরা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা গ্যাস আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দেবে বলেছে।
গ্যাস সংকটে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে অবস্থিত যমুনা সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ কারখানা দেশের সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী। গ্যাস সংকটের কারণে চলতি বছরের ২১ জুন বন্ধ হয়ে যায় এ কারখানার ইউরিয়া উৎপাদন। এর মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে সার উৎপাদন ও সরবরাহে অনিশ্চয়তায় পড়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
যমুনা সার কারখানা থেকে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ি ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার প্রায় আড়াই হাজার ডিলার সার উত্তোলন করেন। কারখানা দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে আসন্ন বোরো-আমন মৌসুমে কৃত্রিম সার সংকটের পাশাপাশি কৃষকদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছে সার ব্যবসায়ীরা।
সার ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিনন বলেন, এখন যদি কারখানা উৎপাদনে না যায় তাহলে আসন্ন ইরি-বোরো মৌসুমে কৃষকদের সার সরবরাহ করতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। এতে করে ডিলাররাসহ কৃষকেরাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রতিবছর কোনো না কোনো অজুহাতে যমুনা সার কারখানা বন্ধ রেখে দেশকে সার আমদানী নির্ভর করে তুলতে চাচ্ছে একটি অসাধু চক্র। নেত্রকোণার সার ব্যবসায়ী সুমন সরকার বলেন, আমরা অতীত থেকে লক্ষ্য করছি যে, ধান লাগানোর মৌসুম আসলেই কোনো না কোনো অজুহাতে কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে। আর এই সুযোগে বিদেশ থেকে কয়েকগুন বেশি মূল্য দিয়ে সার আমদানি করা হচ্ছে। প্রতি টনে সরকারকে ৮০ হাজার টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এতে করে সরকার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু একটি অসাধু চক্র লাভবান হচ্ছে।
তবে এবার আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সহসা সার আমদানি করতে পারছে না সরকার। চলতি অর্থবছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৬ লাখ মেট্রিক টন এবং নিরাপত্তা মজুদ কমপক্ষে আট লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য তিন লাখ ৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এ সার দেশে কবে আসবে তা বলা যাচ্ছে না।
একই অবস্থা চালের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। গেল বোরো মৌসুমে সরকার নির্ধারিত লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ধান চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এতে খাদ্য মজুদ অনেক কমে গেছে। আর এ সুয়োগে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে মত চালের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। চালের লাগামহীন মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০ লাখ মেট্রিক টন আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টন চালও দেশে আসেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন