সরকারের নানামুখি পদক্ষেপে বদলে গেছে সমুদ্র বন্দর মোংলার আমদানি-রফতানির চিত্র। প্রতিদিন ভিড়ছে পণ্যবাহী জাহাজ। রাতদিন চলছে খালাসের কাজ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মেট্রোরেলের মালামাল আমদানি ও খালাসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বন্দর তার পূর্ণ সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। একদিকে পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানীর সাথে মোংলার সড়কপথে দূরত্ব কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে, অন্যদিকে বন্দরে পণ্য খালাসে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে আমদানিকারকেরা তাদের বাণিজ্যে মোংলা বন্দরের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে দেশের শতকরা ৬০ ভাগ গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে। আগামীতে এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও আমদানিকারকেরা। অন্যদিকে, মোংলা কাস্টমসের মোট রাজস্ব আয়ের ৫২ শতাংশ আসছে আমদানি করা গাড়ির শুল্ক থেকে।
সূত্র জানায়, মোংলা বন্দর দিয়ে প্রথম গাড়ি আমদানি শুরু হয় ২০০৯ সালের ৩ জুন। প্রথম চালানে এ বন্দর দিয়ে ২৫৫টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে হক-বে অটোমোবাইল কোম্পানি নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান। ওই বছর মোট ৮ হাজার ৯০৯টি গাড়ি আমদানি করা হয় হয়। এরপর আমদানির সে উচ্চ ধারা অব্যহত রয়েছে। ২০২১-২২ বিদায়ী অর্থবছরে মোংলা বন্দরে সর্বোচ্চ সংখ্যক গাড়ি আমদানি হয়েছে, ২০ হাজার ৮০৮টি।
বন্দর সূত্র জানায়, আমদানিকারকদের বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, স্বল্প সময়ের মধ্যে এই বন্দর থেকে গাড়ি খালাস, আমদানিকৃত গাড়ি রাখার জন্য উন্নতমানের শেড ও ইয়ার্ড নির্মাণ এবং আমদানিকৃত গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক টহল ও সিসি ক্যামেরায় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকার ফলে আমদানিকারকরা আগ্রহী হচ্ছেন। সময় ও অর্থ সাশ্রয় হওয়ার কারণে আমদানিকারকরা এই বন্দরকে বেছে নিয়েছেন। পদ্মা সেতু চালুর ফলে মাত্র সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায় বন্দর থেকে গাড়ি রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এদিকে, মোংলা বন্দরে গাড়ি আমদানি বেড়ে যাওয়ায় খুলনা ও আশেপাশের জেলা শহরগুলোতে এখন গড়ে উঠছে গাড়ির শো-রুম। ক্রেতারা যেখান থেকে সহজেই পছন্দের গাড়ি কিনতে পারছেন।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মোংলা বন্দর স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান আরজু জানান, মোংলা বন্দরের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি আমাদের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক। পদ্মা সেতুর সুফল আমরা গাড়ি ব্যবসায় পাচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের হাতে গাড়ি তুলে দিতে পারছি। আমদানিকৃত গাড়িকে কেন্দ্র করে মোংলা, খুলনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। আর ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার। যে কারণে একটি গাড়ি বন্দর থেকে খালাসের পর কম সময়ে এবং কম খরচে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছতে সক্ষম, তাই বলে মোংলা বন্দর ব্যবহার করে গাড়ি আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মোংলা বন্দরের উপ-সচিব মো. মাকরুজ্জামান জানান, বিদায়ী অর্থবছরের দেশের সমুদ্র বন্দর দিয়ে মোট ৩৪ হাজার ৭৮৩ টি গাড়ি আমদানি করা হয়েছিল। তার মধ্যে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি করা হয়েছিল ২০ হাজার ৮০৮টি। যা মোট আমদানি গাড়ির শতকরা ৬০ ভাগ।
এদিকে, আমদানির পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড় না হওয়ায় বিভিন্ন মডেলের ১১৫টি গাড়ি বিক্রির জন্য নিলামে তুলছে মোংলা কাস্টমস হাউস। আগামী ৭ আগস্ট এই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এবার প্রথমবারের মত গাড়ির নিলাম অনলাইন থেকে বিড করা যাবে।
কাস্টমস হাউসের নিলাম শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু বাসার সিদ্দিকী জানান, নিলামের মধ্যে রয়েছে হাইয়েস, টয়োটা, নোয়া, নিশান, অলিয়ন, প্রাডো ও পিকআপসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১৫৫টি গাড়ি ও ১০টি অন্যান্য আমদানি করা পণ্য। ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে ৭ আগস্ট বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই নিলামের প্রস্তাবিত মূল্য গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা এসব গাড়ি ৩০ দিনের মধ্যে ছাড় করানোর নিয়ম থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা করেননি। ফলে নিয়মানুযায়ী পর্যায়ক্রমে নিলামে ওঠানো হচ্ছে ওই সব গাড়ি। নিলামে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতার তালিকা প্রকাশের পর এই গাড়িগুলো বিক্রি হবে। পরে সর্বোচ্চ দরদাতাকে নিলামে কেনা গাড়ি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান জানান, মোংলা কাস্টমসের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৫২ শতাংশ আসে আমদানি করা গাড়ির শুল্ক থেকে। দীর্ঘদিন আমদানিকৃত গাড়ি বন্দরে পড়ে থাকলে অন্যান্য পণ্য রাখায় সমস্যা তৈরি হয়। নিলাম প্রক্রিয়া চালু রাখলে গাড়ি বা অন্যান্য পণ্য রাখতে ব্যবসায়ীদের সুবিধাও হবে, অন্যদিকে সঠিক সময় সরকারের রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মাদ মূসা (বিএন) বলেন, মেট্রোরেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আমাদনি ও খালাসের মাধ্যমে বন্দর তার পূর্ণ সক্ষমতার প্রমান দিয়েছে। নানাবিধ সুযোগ সুবিধার কারণে গাড়ি আমদানিকারকদের আগ্রহ এখন এই বন্দরের প্রতি। বন্দরের আয় বৃদ্ধিতে গাড়ি আমদানি ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের নানামুখি পদক্ষেপে মোংলাবন্দরের কার্যক্রমে এখন নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর ৭০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এ বন্দরে গত অর্থবছরে ৯৭০টি জাহাজ আগমন করে। একই সময়ে রেকর্ড পরিমাণ ১১৯ দশমিক ৪৫ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং ও খালাস করেছে। এছাড়া ওই অর্থবছরে রিকন্ডিশন গাড়ি এসেছে ১৪ হাজার ৪৪৭টি, যা থেকে মোংলা বন্দর রেকর্ড পরিমাণ ৩৪০ কোটি টাকা আয় করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন