জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বর্ষাকালের ব্যাপ্তি কী আবহমানকালের বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে? গেল জুলাইয়ে অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভরা বর্ষাকালেই সারা দেশে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭.৬ শতাংশ (অর্ধেকেরও কম) বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা গত ৪১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত তথা অকালে খরার রেকর্ড। এ সময়ে গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তপ্ত ছিল আবহাওয়া-প্রকৃতি। ভরা বর্ষা-বাদলের গত জুলাই মাসে সারা দেশে বৃষ্টি ঝরেছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার। মওসুমের এ সময়ে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৯৬ মি.মি.। গড়ে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে ২৮৫ মি.মি.।
জলবায়ুর হিসাবে গত ৩০ বছরে জুলাই অর্থাৎ ভরা বর্ষায় দেশে বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ ৪৯৬ মি.মি.। ভরা বর্ষা মৌসুমে দেশ অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছে। এ কারণে আমন ফসলসহ বৃষ্টি-নির্ভর ফল-ফসল, ক্ষেত-খামারে চাষাবাদ ও উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। খরা পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। দিশেহারা কৃষক। ইতোমধ্যেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে খাদ্য ঘাটতির। বৃষ্টি-নির্ভর অন্যান্য ফল-ফসলও অকাল খরতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবনধারণ, উৎপাদনে পড়েছে খরতপ্ত বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব।
আবহাওয়া বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গেল জুলাইয়ে দেশে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ৩০ বছরে জুলাই মাসের গড় তাপমাত্রার (৩১.১ ডিগ্রি সে.) তুলনায় এবার ২.৬ ডিগ্রি সে. ঊর্ধ্বে। গত ১৩ জুলাই রাজশাহীতে ও ১৪ জুলাই সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা ওই অঞ্চলে জুলাই মাসে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। ১৬ জুলাইয়ে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় সিলেটে ১৬৩ মি.মি.।
গেল মাসে দেশে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সর্বোচ্চ ২.৬ এবং সর্বনিম্ন ০.৯ ডিগ্রি বেশি ছিল। তাছাড়া গত জুন মাসেও দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৩.৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়। তাপমাত্রা ছিল ০.৬ ডিগ্রি সে. ঊর্ধ্বে। গতবছর জুলাই মাসে দেশে গড়ে ৪৭১ মি.মি. (৫.১ শতাংশ কম) বৃষ্টিপাত হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ৫৫৩ মি.মি (১১.৩ শতাংশ বেশি) বৃষ্টি হয়।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরাবর্ষায় খরা-অনাবৃষ্টি এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর নেতিবাচক ধারায় পরিবর্তন। গত কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বিরূপ আচরণে আবহাওয়া-জলবায়ুর অস্বাভাবিক মতিগতি এবং চরম-ভাবাপন্নতা দেখা যাচ্ছে। চলতি আগস্ট মাসেও দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এতে করে খরা-অনাবৃষ্টি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
গতকাল মঙ্গলবার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় গত জুলাই মাসের আবহাওয়ার পর্যালোচনা সূত্রে এ কথা জানা গেছে। দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস প্রদানের লক্ষ্যে গতকাল আবহাওয়া বিভাগের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।
সভায় দেয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, চলতি আগস্ট মাসের দ্বিতীয়ার্ধে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমী ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে বিভিন্ন স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে।
সভা সূত্রে আরও জানা গেছে, ভরা বর্ষাকালের জুলাই তথা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দেশে সার্বিক গড় বৃষ্টিপাত হ্রাস বা অসময়ে খরা অনাবৃষ্টি পরিস্থিতিতে বিভাগ ও অঞ্চলওয়ারি হিসাবে বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি রয়েছে। গত মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ঢাকা বিভাগে ৬০.৫ শতাংশ কম, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৭.৮ শতাংশ কম, খুলনা বিভাগে ৬৪.৬ শতাংশ কম, বরিশাল বিভাগে ৬৪.৭ শতাংশ কম, রাজশাহী বিভাগে ৬১.৮ শতাংশ কম, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫২.৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ সভায় পর্যালোচলায় জানা গেছে, বায়ুমণ্ডলে পর্যাপ্ত জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি, প্রখর সূর্যকিরণ, সাগরে সক্রিয় কোন লঘুচাপ-নিম্নচাপ না থাকা, সর্বোপরি বর্ষার মৌসুমী বায়ু দুর্বল থাকার কারণে জুলাইয়ে খরা-অনাবৃষ্টি এবং তাপদাহ পরিস্থিতি বিরাজ করে।
ফল-ফসলে বিপর্যয়
বছরের শুরুতে উজানের ঢলে হাওর অঞ্চলে বোরো ফসলহানি হয়। তীব্র গরমের জ্যেষ্ঠ মাস থেকে অকাল ঢল-বন্যা কৃষি-খামারের সর্বনাশ ডেকে আনে। এখন ভরা বর্ষায় খরা পরিস্থিতিতে দিশেহারা কৃষক। সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। ভরা বর্ষাকালেই অনাবৃষ্টি, খরার কারণে ফল-ফসল, প্রাণপ্রকৃতি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বছরের গোড়া থেকেই চলমান চরম বৈরী আবহাওয়ার সাথে দেশে ভরা বর্ষা মৌসুমে (জুন-আগস্ট) নজিরবিহীন খরা পরিস্থিতিতে পানির অভাবে ফল-ফসলের বিশেষ করে বর্তমান মুহূর্তে আমন চাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
ফল-ফসল আবাদ-উৎপাদনে তৈরি হয়েছে গুরুতর সঙ্কট। আমন মূলত বৃষ্টি-নির্ভর ফসল। আমন আবাদের বর্তমান প্রয়োজনের মুহূর্তেই বৃষ্টির পানি নেই। পানির অভাব মেটাতে সেচ দিতে হচ্ছে। আর সেচের খরচ মেটাতে গিয়ে কৃষকের নাভিশ^াস অবস্থা। সেচের ব্যয় মেটানোর সাধ্য অধিকাংশ কৃষকের নেই। তাছাড়া অনেক জায়গায় সেচের জন্য পানির উৎসগুলোও শুকিয়ে গেছে। একদিকে অনাবৃষ্টির কারণে পানির চাহিদা পূরণের জন্য কৃষক সেচের ব্যয় মেটাতে পারছেন না। বৃষ্টির আশায় বেশিরভাগ আমন চাষযোগ্য জমি এখনও অনাবাদী পড়ে আছে।
আবার রোপা আমন চাষে যতই বিলম্ব হবে ততই আবাদ, ফলন বা উৎপাদন কমে যাবে। দেশের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৩৯ শতাংশই আসে আমন ধান থেকে। বর্তমানে দেশে ভরাবর্ষায় খরা পরিস্থিতির কারণে মাত্র ৯ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। অথচ আমন চাষে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৫৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। অনাবৃষ্টির কারণে বিকল্প সেচের মাধ্যমে আমন চাষের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কৃষকরা হতাশা ব্যক্ত করে জানান, সেচের বাড়তি ব্যয়ের সঙ্গতি নেই বেশিরভাগ কৃষকের।
এদিকে চলতি আগস্ট মাসের পূর্বাভাসে জানা গেছে, এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি বর্ষাকালীন লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে একটি মৌসুমী নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এ মাসে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সে.) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন