শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

পয়েলা আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস : মাতৃদুগ্ধপানে ইসলামের দৃষ্টিকোণ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৬ এএম

সোমবার বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস-২০২২। ১৯৯০ সালের ইতালির ফ্লোরেন্সে ইনোসেনটি গবেষণা কেন্দ্রের ঘোষণার সম্মানে ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ সারা বিশ্বে মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উৎসাহিত করতে একটি বৈশ্বিক প্রচারাভিযান। মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহর প্রথম দিন ১ আগস্টকে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে বিভিন্ন দেশের সরকার, ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচওসহ অন্যান্য সংস্থা। ১৯৯১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই ঘোষণাপত্র সমর্থন করে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন (ডব্লিউএবিএ) নামের একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। জাতিসংঘের দুই সংস্থাসহ সরকারি উদ্যোগে ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্বের ১৭০টির বেশি দেশে পালিত হয় সপ্তাহটি।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাতৃদুগ্ধ পানে শিশু যেমন সুস্থ–সবল হয়ে বেড়ে ওঠে, তেমনি উপকৃত হন প্রসূতি নিজেও।
শুধুই মাতৃদুগ্ধ পান করালে বছরে আট লাখের বেশি শিশুর জীবন রক্ষা পাবে। যে শিশুদের বেশির ভাগেরই বয়স ছয় মাসের কম। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর কোন বিকল্প নেই। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে মা ও শিশু দুজনেরই উপকার হয়। জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ দিলে মায়ের গর্ভফুল তাড়াতাড়ি পড়ে, সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়, ফলে মা রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা পায়। জন্মবিরতিতে সাহায্য করে, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়। শিশুর সর্বোচ্চ শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ডায়রিয়া হওয়ার প্রবণতা এবং এর তীব্রতার ঝুঁকি কমায়, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং কানের প্রদাহ কমায়, দাঁত ও মাড়ি গঠনে সহায়তা করাসহ অনেক উপকারিতা আছে।
মায়ের দুধ না খাওয়ালে- নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৫ গুণ বৃদ্ধি পায়, ডায়রিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১১ গুণ বৃদ্ধি পায়, শিশুদের অপুষ্টি ও অন্যান্য, কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ বৃদ্ধি পায়, জন্ডিস, কানপাকা ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণসহ ডায়রিয়া হওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পায়। শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। বয়সের তুলনায় ওজন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়; দীর্ঘস্থায়ী রোগের (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থুলতা) ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ ২০২২ উপলক্ষ্যে জাতীয় পুষ্টি সেবা, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি,বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যা মাসব্যাপী পালিত হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১৪ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উদ্বোধন করেন ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। বিশ্বে প্রতি পাঁচটি শিশুর তিনজনই জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মাতৃদুগ্ধ পায় না।
দুই বছর পর্যন্ত স্তন্যপান করাতে পারলে বছরে ৮ লাখ ২০ হাজার শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। দুগ্ধদান করে মায়েরাও জীবনসংহারী অনেক রোগ ঠেকিয়ে দিতে পারেন; সেজন্য তাদের আরও উৎসাহিত করতে বলেন চিকিৎসকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, জন্মের প্রথম ঘণ্টাতেই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধই খাবে শিশু, এমনকি পানিও খাওয়ানো যাবে না। এরপর পরিপূরক খাদ্যের সঙ্গে অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালিত হয়ে আসছে সেই ১৯৯২ সাল থেকে।
কিন্তু এখনও জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো হয় বিশ্বের মাত্র ৪১ শতাংশ শিশুকে। এই হারকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি। আর আমাদের দেশে এখন হাজার হাজার মা নিজের বুকে দুধ পান করার পরিবর্তে বাজারে কৃত্রিম দুধ পান করান নিজের সৌন্দর্যকে ধরে রাখার জন্য। এতে লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। ভবিষ্যত জীবন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে শিশুর। মায়ের দুধ হচ্ছে শিশুর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খাবার এবং পানীয়। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ মায়ের দ্রুত আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই।
মাতৃদুগ্ধপানে ইসলামের বিধানঃ- শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ অপরিহার্য। কারণ মায়ের বুকের দুধে রয়েছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ ও উপাদানযুক্ত আল্লাহ প্রদত্ত এমন তৈরি খাবার, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে এবং সহজেই শিশুর দেহ বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাইতো আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের জন্মের পর তাঁর মাকে নির্দেশ দেন, ‘আমি মুসার মায়ের অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলাম, তাকে দুধ পান করাও।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৭)জন্মের পর শিশুর জন্য সর্বোত্তম খাবার হলো মায়ের বুকের দুধ। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের বুকে দুধ সৃষ্টি করে রাখেন। যা হালকা মিষ্টি ও উষ্ণ; যা নবজাতক শিশুর নাজুক অবস্থার জন্য বিশেষ উপযোগী।
নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘স্তন্যদানকারী ও গর্ভবর্তী মহিলা থেকে রমজানের রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ ও মিশকাত)বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের ব্যাপারে যে গুরুত্বের কথা বলে, সে গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বেই ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনেই নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা বিধান ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা সুরা লোকমানের ১৪নং আয়াতে বলেন, ‘আমি তো মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করে। অতঃপর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে।’অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ২৩৩)কুরআন ও হাদিসের আলোচনা থেকে বুঝা যায়-শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময়সীমা হল, জন্মের পর থেকে চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী পূর্ণ দুই বছর। শিশুর প্রয়োজনে এ সময় আরো ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে।আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন, ‘তাকে গর্ভধারণ করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস। (সুরা আহকাফ : আয়াত ১৫)
মা ও শিশুর শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো থেকে বিরত থাকার কথাও বলা হয়েছে।তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের দেহপসারিণী (ব্যভিচারী নারী) ও পাগল মহিলার দুধ পান করানো থেকে দূরে রাখ।’আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে জানা যায় যে, দেহপসারিণীর (ব্যভিচারী নারীর) দুধ পানে ‘হেপাটাইটিস বি’ ও ‘এইডস’-এর মতো ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে শিশু। তাই ক্ষেত্র বিশেষ শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো থেকে বিরত রাখার কথাও বলা হয়েছে ইসলামে।সর্বোপরি শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করালে শিশু ও মায়ের মধ্যে এমন একটি মানসিক বন্ধন তৈরি হয়, যা চিরস্থায়ী।
মুসলিম উম্মাহর সব শিশুর মায়ের উচিত কুরআনের হুকুম অনুযায়ী তাঁর সন্তানকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করানো। পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করানোর পর প্রয়োজনে অতিরিক্ত আরো ছয় মাস শিশুকে দুধ পান করানো যেতে পারে।পরিশেষে মায়ের দুধ মহান আল্লাহর একটি বিশেষ নিয়ামত। কারণ, অনেক মায়ের সন্তান হওয়ায় পরও শিশুকে পান করার মতো পরিমাণ দুধ হয় না। এ ক্ষেত্রে পূর্বে থেকে মায়েদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। আর ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃদুগ্ধ নবজাত শিশুর জন্মগত অধিকার। যাতে কোনো কারণে এটি খর্ব না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা ‘আজকের শিশু, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ দানকে উন্নয়ন ও সহায়তা করা।
ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুদের মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে মায়েদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। মাতৃদুগ্ধ যাতে শিশুরা নিয়মিত পায় এ জন্য মায়েদের মধ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মায়ের দুধের অনন্য ভূমিকার কথা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান মায়ের দুধ খাওয়ানোর ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করছে। বিষয়টি মায়েরা মন দিয়ে উপলদ্ধি করলেই মঙ্গল।
পরিশেষে বলতে চাই, শিশুদের শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্য মায়ের বুকের দুধ খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এটা শিশুর জন্য মায়ের কাছে অধিকার বা প্রাপ্য রয়েছে। মায়ের দুধপান করা শিশুর মৃত্যুহারও একেবারে কম।আল্লাহ তাআলা সব মাকে কুরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী শিশুদেরকে নিজেদের বুকের দুধ পান করিয়ে আল্লাহর হুকুম পালন করার ও শিশুর যথাযথ যত্ন নেয়ার তাওফিক দান করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন