রাজধানীসহ সারাদেশে পেশাদার অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে সক্রিয় থাকে অপরাধী চক্র। এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। দল বেধে ধর্ষণের পাশাপাশি পিছিয়ে নেই অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, চোর-ডাকাতরাও। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছিনতাইসহ নানা অপরাধ ঘটাচ্ছে তারা।
এ কারণে সাধারণ লোকজনদের মাঝে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। গত সপ্তাহে ঈগল পরিবহনের একটি বাস বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রীবেশী ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের হাত, চোখ, মুখ বেঁধে একজন যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় রাতে চলাচলকারী যাত্রীদের মধ্যে বিরাজ করছে ভয় ও আতস্ক।
গত ৩ আগস্ট রাজধানীর আশকোনায় হাজি ক্যাম্প এলাকায় থেকে বিআরটিসি বাসে কারওয়ান বাজার যাচ্ছিলেন গাজীপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. শফিকুল ইসলাম। এ সময় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন তিনি। এই ঘটনার পরদিন উত্তরা পশ্চিম থানার ১০ নম্বর সেক্টরের সøুইস গেট এলাকার রাস্তায় মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন কলেজছাত্র সাজেদুর রহমান রুবায়েদ। মোটরসাইকেলে পেছন থেকে এসে আচমকা রুবায়েদের মোবাইল ফোন টান দিলে তিনি ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন। ছিনতাইকারী নাম পিয়াল হোসেন।
মামলা তদন্তকারী একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অপরাধের নির্দেশদাতা গডফাদারদের পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্যকে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো ভয়ঙ্কর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারন।
অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, ক্রিমিনোলজিতে পানিশমেন্ট ফিলোসপি অনুযায়ী যখন কোনো অপরাধে কারও শাস্তি হবে। তখন অন্য কেউ একই অপরাধ করতে ভয় পাবে। অপরাধীদের ভেতরে ভয় ঢুকবে যে অপরাধ করলে শাস্তি নিশ্চিত। আর এ ধরনের নৃশংস ঘটনা কেউ ঘটাবে না। নৃশংসতাও কমে আসবে। এজন্য আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অপরাধ সঙ্ঘটনের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইন প্রয়োগ এবং বিচারে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা না গেলে অপরাধীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা কঠিন। অথচ দেশে অনেকে অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, যা আইনের শাসনের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছোট অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া সাধারণ অপরাধী বড় অপরাধে উৎসাহী হয়ে উঠছে। নানা ফাঁক-ফোকর গলিয়ে অপরাধীরা আইনি গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় আইনের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা দোদুল্যমান। ফলে বিভিন্ন সময় কেউ কেউ আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়াচ্ছে।
দেশের অপরাধ চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ছোট ছোট অপরাধ করে যেসব অপরাধী পার পেয়েছে কিংবা জামিনে বেরিয়ে এসেছে, এদেরই একটি বড় অংশ পরে বীভৎস ও বড় অপরাধে জড়িয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনতা আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে নিজেরাই কঠিন সাজা দেয়ার চেষ্টা করছে। এর ধারাবাহিকতায় অনেক জায়গায় গণপিটুনিতে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের মৃত্যু ঘটছে। আবার অপরাধী সন্দেহে উত্তেজিত জনতার গণধোলাইয়ে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর খারাপ দৃষ্টান্তও রয়েছে। এ ধরনের ঘটনার ফলে সমাজে এক প্রকার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সামাজিক মূল্যবোধ নিয়েও প্রশ্ন জাগছে।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশে আইনের শাসন যেহেতু দুর্বল, তাই খুন-খারাবি, অপরাধ ও বিচারে সর্বক্ষেত্রেই এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিচারে অনেক সময় প্রকৃত আসামিদের শাস্তি হচ্ছে না। তারা ফাঁকফোকর গলিয়ে জামিনে বের হয়। আবার বেশির ভাগ হত্যা মামলার বিচার অনেক ধীরগতিতে হয় এবং বিচারে শাস্তিও হয় না-এসব কারণে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
তিনি বলেন, যেখানে সন্ত্রাসী অপরাধীরা সাধারণভাবে আইন মানে না। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা করে না। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে থাকা বিপথগামী কেউ কেউ প্রশিক্ষণ-অস্ত্র সরঞ্জামাদি অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করছে। এতে করে সঙ্কট বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, এমন একটি জনবসতিপূর্ণ শহরে বিচ্ছিন্নভাবে দুই একটি ঘটনা (ছিনতাই) ঘটতেই পারে। তবে যারাই এসব অপকর্ম ঘটাচ্ছে তাদেরকে ধরা পড়তেই হচ্ছে। অপরাধ করে কোনো অপরাধী পার পাচ্ছে না। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এমন প্রতিটি ঘটনাতেই জড়িতদের গ্রেফতার করতে সফল হয়েছে পুলিশ। কমিশনার বলেন, ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, চোর-ডাকাতসহ পেশাদার বা চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, সদরঘাট, বিমানবন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন সড়কেই ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। অনেক সড়ক, ফ্লাইওভার এবং ফুটওভার ব্রিজে রাতে বৈদ্যুতিক আলো না থাকার সুযোগে রাত্রিকালীন আস্তানাও গাড়ছে ছিনতাইকারীসহ পেশাদার অপরাধীরা।
ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষকও জড়াচ্ছেন ছিনতাইয়ে : পুলিশ সূত্র জানায়, ইদানীং ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং ও শিক্ষকতার মতো পেশার লোকজনও। পেশাজীবী থেকে এসব ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন পেশাদার ছিনতাইকারী। রাজধানীর ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন আশরাফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। করোনাকালে বেতন কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে জড়িয়ে পড়েন ছিনতাইয়ে। এখন তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার ছিনতাইকারী।
মাসুদ রানা হাওলাদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারেও ইংরেজি পড়াতেন। কিন্তু করোনার মধ্যে স্কুল ও কোচিং সেন্টারের চাকরি হারান তিনি। হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে অভাব ও হতাশা। একপর্যায়ে একটি ছিনতাইচক্রে যোগ দেন। বাড্ডা, রামপুরা ও খিলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে বেড়ান তিনি।
গত বছরের ডিসেম্বরে মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকায় এক সরকারি কর্মকর্তার ১১ লাখ টাকা ও পরে মোহাম্মদপুরে আরেক সরকারি কর্মকর্তার ২৩ লাখ টাকা ছোঁ মেরে নিয়ে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান দুই ছিনতাইকারী। এ দুই ঘটনার পর অভিযানে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এতেই বেরিয়ে আসে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের পরিচয়। শুধু ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষকই নন, এ তালিকায় রয়েছেন ডাক্তার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, সমাজের প্রথমসারির পেশার যেসব ব্যক্তি ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়েছেন তাদের দিয়ে ওইসব পেশায় জড়িত অন্যদের বিচার করা যাবে না। আমরা ব্যতিক্রমী কয়েকটি ঘটনা পেয়েছি। একেকজন একেক কারণে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. তৌহিদুল হক বলেন, একজন মানুষ গড়ে ওঠার সময় যদি অসদুপায় অবলম্বন করেন কিংবা আশপাশে নৈরাজ্য ও অনৈতিকতা দেখে বড় হন তাহলে তার মধ্যে অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠনের প্রবণতা থাকবেই। ফলে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক হলেই চারিত্রিকভাবে ভালো হবেন কিংবা মর্যাদাবান ব্যক্তি হবেন তা বলা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন