আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে থেকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে এসব জানানো হয়। রেকর্ড হারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বাস ও লঞ্চে ভাড়ার পরিমাণ কত বাড়তে পারে, তার একটি ধারণা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা। তার আগে এই দুই জ্বালানি তেলের দাম ছিল লিটারে ৬৫ টাকা। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ায়নি সরকার। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। গত বছরের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ৮৩ দশমিক ৩৫ মার্কিন ডলার। গত জুলাই মাসে যা ছিল ১৩৯ দশমিক ৪৩ মার্কিন ডলার। আর একই সময়ে অকটেনের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৮৫ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার, গত জুলাইয়ে যা ছিল ১১৪ দশমিক ৯৬ মার্কিন ডলার। তবে গত মে ও জুন মাসের তুলনায় এ দাম কিছুটা কম।
মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল প্রতি ব্যারেল ৭৪ দশমিক শূন্য ৪ ও অকটেন ৮৪ দশমিক ৮৪ মার্কিন ডলারে নেমে এলে ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার যথাক্রমে ৮০ ও ৮৯ টাকায় বিক্রি সম্ভব হতো, (তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এই দামে বিক্রি) যা এখন প্রায় অসম্ভব। গত জুলাইয়ে ডিজেল ও অকটেনে বিপিসি প্রায় ৭৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর আগের দুই মাসে লোকসানের পরিমাণ ছিল শতাধিক কোটি টাকা। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসি ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকার ওপরে লোকসান দিয়েছে। এখন প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায় বিক্রি হলেও বিপিসিকে ৮ দশমিক ১৩ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মাসের তথ্য অনুযায়ী ভারতের কলকাতায় ডিজেল প্রতি লিটার ৯২ দশমিক ৭৬ রুপিতে (১১৮.০৯ টাকা) বিক্রি হয়। ওই সময়ের হিসাবে কলকাতার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ টাকা বেশি ছিল। আর পেট্রলের দম বেশি ছিল প্রতি লিটার প্রায় ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা। এ পার্থক্যের কারণে জ্বালানি পণ্যের পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মূল্য সমন্বয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি পণ্যের মূল্যের পার্থক্যজনিত পাচার রোধ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার দিনগত রাতে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা করা হয়। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের ৪৬ টাকা এবং পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় গতকাল রাত ১২টা থেকেই। দাম বাড়ার পর প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা ও প্রতি লিটার পেট্রল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রল ৮৬ টাকা।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে অঘোষিতভাবে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা। সীমিত পরিসরে যান চলাচল করলেও নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছেমতো বর্ধিত ভাড়া। কিছু এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পেট্রলপাম্প। পাশাপাশি বিক্ষোভও করেছেন পরিবহন শ্রমিকেরা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর আগে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর দেশে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের ভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাড়া নির্ধারণী কমিটি। একইভাবে মহানগর এলাকার বাসভাড়া ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। একই দিন সব লঞ্চের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ৬০ পয়সা করে ভাড়া বেড়েছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন