শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়াচ্ছে দেওয়ানি মামলা

ভূমি নিবন্ধনে ফাঁক-ফোকর একজনের জমি নিয়ে যাচ্ছে অন্যজন

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিদ্যমান ভূমি নিবন্ধন আইন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা বাড়াচ্ছে। একজনের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে অন্যজন। ভুয়া মালিক সাজিয়ে আম মোক্তারনামার মাধ্যমে সৃজন করা হচ্ছে ভুয়া দলিল। কখনও করা হচ্ছে ‘খাড়া দলিল’। রাজস্ব ফাঁকি দিতে নিবন্ধনে ছল-চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন খোদ নিবন্ধন কর্মকর্তা-কর্মচারিরাই।এর ফলে একদিকে যেমন দেওয়ানি মামলার হার বাড়ছে-তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন, ভূমি হস্তান্তরে স্বচ্ছতা আনয়ন, জালিয়াতি রোধ এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের লক্ষ্যে সরকার ২০০৪ সালে ভূমি রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন-২০০৪ কার্যকর করে।এ আইন তাৎক্ষণিক ভাবে ভুক্তভোগীদের মহলের প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই আইনটিতে ধরা পড়ে বহু অসঙ্গতি। নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় জালিয়াতি ও রাজস্ব ফাঁকির। ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা হলেও ভূমি রেজিস্ট্রেশন আরও জটিল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান গুলো এখনও পুরনো নিয়মে পরিচালিত হওয়ায় হস্তান্তর যোগ্য ভূমির শেষ ২৫ বছরের ইতিহাস, এস.এ. পর্চা, আর.এস পর্চা এবং নাম জারির ক্ষেত্রে আগের জটিলতাই রয়ে গেছে। বরং ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অর্ধেক অংশ (রেজিস্ট্রেশন) নতুন নিয়মে অর্ধেক সনাতন (নাম জারি, এস.এ. পর্চা, আর.এস, পর্চা ) নিয়মে করতে হয় বিধায় মানুষ এখনও হালনাগাদ রেজিস্ট্রেশন আইনের পরিপূর্ণ সুফল পাচ্ছে না। তাছাড়া নতুন নিয়মে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া কিছুটা দুর্নীতি মুক্ত হলেও তহসিল অফিস ও ভূমি অফিসগুলোতে হয়রানি এবং দুর্নীতি বাড়ছে।
রাজধানীর ডেমরা থানাধীন কোনাপাড়ার বাসিন্দা মতিউর রহমান জানান, ওই থানার ধার্মিক পাড়া মৌজার ১৮৩, ১৮৪ দাগের ৪২শতাংশ জমি খাড়া দলিল দেখিয়ে অন্য একজন বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০০০ সালে জমিটি তিনি কিনেছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি একবার জমিটি বিক্রির উদ্যোগ নেন। এ সময় একটি অসাধুচক্র জমি ক্রয়ের কথা বলে তার কাছ থেকে কাগজপত্র হাতিয়ে নেয়। সেই কাগজপত্রের ভিত্তিতে পরবর্তীতে চক্রটি খাড়া দলিল করে। সাব-রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া একজনকে‘মতিউর রহমান’ সাজিয়ে ২০১০ সালে জালিয়াতচক্র ৮ জনের নামে দলিল করে। দলিলে ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রারের সীল-স্বাক্ষরও রয়েছে। সেই দলিলের ভিত্তিতে পরবর্তীতে চক্রটি খাজনা-খারিজ করায়। চক্রের সদস্যরা গোপনে জমিটি অন্যএকজনের কাছে বিক্রিও করে দেয়। কথিত এই ক্রেতা জমি দখল নিতে এলে খাড়া দলিলের বিষয়টি অবগত হন মতিউর রহমান। বিষয়টি জানার পর তিনি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করেন। মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে। জমিটির বর্তমান বাজার মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি।
তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে আসা ভুক্তভোগী আমির হেসেন জানান, তার জমির ২৫ বছরের ইতিহাসের এক পর্যায়ে একজন হিন্দুর নাম চলে আসে। এজন্য তাকে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হয়েছে। ভূমি অফিস এবং এসি(ল্যান্ড)কে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির আওতায় না আনায় জমির অনেক প্রকৃত মালিকও জমি হস্তান্তর করতে পারছেন না। আর এসব জটিলতার কারণেই আইন থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতি হ্রাস পায়নি।
নিবন্ধন আইনে ফাঁক-ফোকর থাকার কারণে এখনও ‘খাড়া দলিল’ সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন দেওয়ানি আইন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বারের অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, দেওয়ানি মামলার উৎস স্থল হচ্ছে তহশিল, এসি (ল্যান্ড) এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস যদি রেকর্ডপত্র যাচাই করে নিবন্ধন করতো তাহলে জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়ই জালিয়াতি ধরা পড়তো। ফলে অর্ধেক দেওয়ানি মামলা এমনিতেই কমে যেতো। ভূমি জটিলতা নিরসনে প্রকল্পের আওতায় বড় পড় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও কার্যত: ভুক্তভোগীরা কোনো সুফল পাচ্ছেন না। ফলশ্রুতিতে শুধু উচ্চ আদালতেই এখন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।
নিবন্ধন অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমান আইনে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার ছবি সংযুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করা হলেও এর মাধ্যমে জালিয়াতি রোধ করা যাচ্ছে না। ভুয়া ব্যক্তিকে জমির মালিক বানিয়ে বিক্রয় নিবন্ধন চলছে। এ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনকালে ভুয়া ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হলেও পরে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারিদের যোগসাজশে জমির প্রকৃত মালিকের ছবি সংগ্রহ করে গোপনে তা যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। সাব- রেজিস্ট্রারদের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এনআইডি যাচাই করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে ভুয়া এনআইডি কার্ড। ফলে জমির প্রকৃত মালিকের অজ্ঞাতেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জমি। প্রকৃত মালিক জমি ফেরত পাওয়ার জন্য অবলম্বন করতে হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘ পথ। জমি নিবন্ধনে জালিয়াতি রোধ করা না গেলে দেওয়ানি মামলার হার বাড়তেই থাকবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
নিবন্ধনে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন নিবন্ধনকারী সাব-রেজিস্ট্রার স্বয়ং। কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এরকম ঘটনা ধরা পড়লে স্থানীয়ভাবে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মানিকগঞ্জ পালপাড়া গ্রামের সফিউদ্দিনের স্ত্রী রহিমা খাতুন। তিনি ভাটভাউর মৌজার ৮১ শতাংশ জমির আমমোক্তার নামা দেন বান্দুটিয়ার মো. ওবায়দুল কবীর এবং পশ্চিম দাশড়ার মো. সালাহউদ্দিনকে। মানিকগঞ্জ সদরের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার পৃথক দুটি দলিলে (নং-৪৪৭৯ ও ৪৪৮০) আম মোক্তারনামা দুটি নিবন্ধন করেন। কিন্তু পরের মাসে সিঙ্গাইর থানার জয়মন্টপের আরেক মহিলাকে রহিমা খাতুন সাজিয়ে প্রকৃত রহিমা খাতুনের আমমোক্তার নামা বাতিল করা হয়। মানিকগঞ্জ সদরের তৎকালিন সাব-রেজিস্ট্রার মহসিন মিয়া কমিশনে কথিত রহিমা খাতুনের বাসায় গিয়ে আম মোক্তার নামা বাতিল এবং স্বত্ব দখলীয় ভূমির মালিকানা ফিরিয়ে নেয়ার দলিলটি (নং-৫২৯৯ এবং ৫৩০০) নিবন্ধন করেন। একই জমি ভূয়া রহিমা খাতুনকে দিয়ে ৭টি দলিলের (নং-৫৪৩৮ থেকে ৫৪৪৪ পর্যন্ত) মাধ্যমে বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি ও দানপত্র নিবন্ধন করেন ওই সাব-রেজিস্ট্রার। জমির প্রকৃত মালিক রহিমা খাতুনের ছবি সরিয়ে ভুয়া রহিমা খাতুনের ছবি ব্যবহার করা হয় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। গুরুতর এ জালিয়াতির ঘটনায় মানিকগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রার মহসিন মিয়া, বিল্লাল হোসেন এবং বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত টি. সি. মোহরার গুরুদাস পালের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ (ডিআর নং-৬৯২/) এনে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিকার দাবী করেন রহিমা খাতুন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি বলে জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, জাতীয় রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত নিবন্ধন। এ খাতের ১৩টি উপ-খাত থেকে সরকার বছরে অন্তত: ৫শ’ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পায়। এর মধ্যে রয়েছে, দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি, রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের অনুলিপি ফি, অন্যান্য ফি, উৎসে কর, স্ট্যাম্প (নগদ, হলফ ও চালান),স্ট্যাম্প ডিউটি, দলিল লিখকদের লাইসেন্স/নবায়ন ফি, টেন্ডার ও অন্যান্য দলিলপত্র, নিকাহ রেজিস্ট্রার কর্তৃক জমাকৃত ফি, হস্তান্তর নোটিশ/কোর্ট ফি এবং স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর কর। নিবন্ধন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব আইনের আওতায় থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে তৎপর থাকা। কিন্তু তা না করে নিজেরাই রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসবে মেতে থাকেন নিবন্ধনের কোনো কোনো কর্মকর্তা।
নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তাদেরই রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে নিবন্ধন অধিদফতরের মহা-পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম ঝিনুক এ প্রতিবেদককে বলেন, আইনত: একজনের জমি আরেকজনের পক্ষে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে কিছু কিছু দুর্বলতা আমাদের রয়েছে। যেমন, এসি(ল্যান্ড) অফিস এবং তহশিল অফিসের রেকর্ডপত্র এবং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরগুলো আমরা ভেরিফাইল করতে পারি না। যদিও অফিসগুলো বলছে, সব কাগজ অনলাইনে দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সেগুলো সার্ভারে ঢুকে যাচাই করতে পারি না। দ্বিতীয়ত: জমি নিবন্ধনে ক্রেতা-বিক্রেতার এনআইডি কার্ডের কপি সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু নিবন্ধনের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা যে এনআইডি সংযুক্ত করেন সেটির সঠিকতা আমরা যাচাই করতে পারি না। তবে আশার কথা হচ্ছে, এনআইডি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের একটি এগ্রিমেন্ট হয়েছে। আমরা সার্ভারে প্রবেশ করে এনআইডি যাচাই করার এখতিয়ার পাবো। আশা করছি শিঘ্রই এই জটিলতার অবসান ঘটবে।
এদিকে আইনমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভূমি জটিলতা লাঘব এবং ভূমি বিরোধ হ্রাসে আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একাধিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ডকুমেন্ট ডিজিটালাইজেশনসহ বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলেই ভূমি বিরোধ বহুলাংশে কমে আসবে বলে আশা করছে আইনমন্ত্রণালয়। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে সম্মত হননি আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোয়ার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন