নাছিম উল আলম : বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও আশুগঞ্জ নৌপথ উন্নয়ন এবং চট্টগ্রাম-বরিশাল-খুলনা-মংলা ও চাঁদপুর-শরিয়তপুর ফেরি রুটে নাব্যতা উন্নয়নের পাশাপাশি ১৪টি ল্যান্ডিং স্টেশন ও কয়েকটি টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ ও নির্মাণে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে ৬টি জাহাজ আশ্রয় কেন্দ্রও স্থাপিত হবে। এসব স্থানে দুর্যোগকালীন সময়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান নিরাপদে আশ্রয়লাভ করবে। ৩ হাজার ২শ’ কোটি টাকার ঐ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে। দেশের নৌ পরিবহন সেক্টরের বড় মাপের এ প্রকল্পটি অতি সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ‘একনেক’-এর সভায় অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে ২টি বিদ্যমান যাত্রী নৌটার্মিনাল ভবনের সম্প্রসারণ ছাড়াও ঢাকার শশ্মান ঘাট ও চাঁদপুরে দুটি নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মিত হবে। এছাড়া ঢাকার পানগাঁও ও আশুগঞ্জে ২টি কার্গো টার্মিনালও নির্মিত হবে এ প্রকল্পের আওতায়।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বড় মাপের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। কর্তৃপক্ষে পরিচালক-পরিকল্পনা ও ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক গতকাল ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথসমূহ ছাড়াও ভোলা-লক্ষ্মীপুর, ভোলা-বরিশাল এবং বরিশাল-ঝালকাঠী নৌপথে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিংসহ সংরক্ষণ ড্রেজিংও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তার মতে অনেক ক্ষেত্রেই ড্রেজিং করার পরে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হত না নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে নতুন এ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং করে পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংও করা হবে। প্রকল্পটির আওতায় উল্লেখিত নৌপথসমূহের ৯শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং ছাড়াও তা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এসব নৌপথ চার থেকে সাড়ে ৪ মিটার গভীরতায় ৭৫ মিটার প্রশস্ত করে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে প্রায় ৪০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হবে। পরবর্তী সময়ে এসব নৌপথে নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিংও নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। তবে যেসব নৌপথে গভীরতা ও প্রশস্ততা ডিপিপি’তে উল্লেখিত মাত্রার চেয়েও বেশী রয়েছে, সেসব নৌপথও ড্রেজিং করার কথা উল্লেখ রয়েছে প্রকল্পটিতে। এসব বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, ‘ডিপিপি’তে সব কিছু বিস্তারিত উল্লেখ করা সম্ভব হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে সব কিছু সরেজমিনে খতিয়ে দেখেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মাঠ পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শক ও পর্যবেক্ষক দলও প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখে তা অনুমোদনের পরেই কেবল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে’ বলেও জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টগণ। প্রকল্পটির আওতায় ভোলা-লক্ষ্মীপুর, ভোলা-বরিশাল ও চাঁদপুর-শরিয়তপুর ফেরি রুটে ফেরি পারাপার নির্বিঘœ রাখতে এসব ঘাটের বেসিনগুলাও উন্নয়ন এবং পরিপূর্ণ সংরক্ষণের কথা রয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত একটি প্রকল্পে এত দীর্ঘ নৌপথ খনন করা হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়ন লক্ষের এ প্রকল্পটিতে উল্লেখিত ৩টি ফেরিরুটসহ বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। এসব ল্যান্ডিং স্টেশনে যাত্রী ও ফেরি ব্যবহারকারীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছন প্রকল্প সংশ্লিষ্টগণ। তবে এসব ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের আগে সন্নিহিত নদ-নদীর গতিপথসহ সড়ক অবকাঠামোর সুযোগ-সুবিধাসমূহ পরিপূর্ণ বিবেচনা ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে স্থান নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছন ওয়াকিবহাল মহল। ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে বর্তমানে ইলিশা ও মজুচৌধুরীর হাটে ফেরিঘাট এবং লঞ্চঘাট থাকলেও মেঘনার অব্যাহত ভাঙন ও চড়া পরার কারণে বর্ষা ও শুষ্ক মৌশুমে এসব ঘাট সারা বছর সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু অসংখ্য ডুবো চরার কারণেই ১৬ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনা পাড়ি দিয়ে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যেতে ২৮ কিলোমিটার নৌপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। নদী ভাঙনে গত কয়েক বছর ধরে ভোলার ইলিশার ফেরি ঘাটটি বর্ষা মৌশুমে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হচ্ছে। আবার লক্ষ্মীপুর প্রান্তের মজুচৌধুরীর হাট ফেরি ঘাটটি শুষ্ক মৌশুমে ভাটার সময় বন্ধ হয়ে হচ্ছে রহমতখালী চ্যনেলের মুখে নাব্য সংকটে।
এসবের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে মজুচৌধুরীর হাট ঘাটটি প্রায় ৫ কিলোমিটার ভাটিতে মতিরহাট এলাকায় মূল মেঘনাপাড়ে সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। গতবছর নৌ পরিবহন মন্ত্রীও বিষয়টি উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থমকে যায়। মতিরহাটে ঘাট স্থানান্তর করলে, নৌপথের দূরত্ব হ্রাসসহ মেঘনার নাব্য সংকট এড়িয়ে ফেরি সার্ভিস কিছুটা নির্বিঘœ হবে। তবে লক্ষ্মীপুর থেকে সড়ক পথে প্রস্তাবিত ফেরি ঘাটের দূরত্ব বাড়বে। উপরন্তু লক্ষ্মীপুর সদর থেকে মতিরহাট পর্যন্ত রাস্তাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। ফলে তা আঞ্চলিক বা জেলা সড়কের স্তরে নির্মিত না হওয়ায় পুরো সড়কটি পুনঃনির্মাণ করতে আরো বিপুল অর্থ ব্যয়সহ দীর্ঘ সময় ব্যয় হবে।
তবে এব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট ঐ প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছন, ‘বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হলে যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সব কিছু চূড়ান্ত করা হবে। প্রকল্পটির আওতায় বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে বিদ্যমান নৌ টার্মনাল ভবনসমূহ সম্প্রসারণসহ আরো নতুন পন্টুন স্থাপন করা হবে বলেও জানা গেছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ভোলা-বরিশালের মধ্যবর্তী লাহারহাট-ভেদুরিয়া এবং চাঁদপুর-শরিয়তপুরের আলুবাজার-হরিনঘাটা ফেরিরুটের নাব্যতা উন্নয়ন ছাড়াও ফেরি চলাচল নির্বিঘœ করাসহ যাত্রী সবিধাসমূহ সম্প্রসারণেরও কথা রয়েছে।
চলতি অর্থ বছরের চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী থেকে কিছু থোক বরাদ্দ রেখে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চলছে। আগামী ২০১৯ সাল নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি নির্ধারত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শুরু ও শেষ করতে। ড্রেজিংসহ প্রতিটি অবকাঠামা নির্মাণ ও উন্নয়নে সর্বোচ্চমান নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এ লক্ষে বিশ্বব্যাংকও পরামর্শক নিয়োগ করবে। খুব শিঘ্রই প্রকল্পটির আর্থিক সহায়তার লক্ষে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বহিঃসম্পদ বিভাগের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সাথে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ আন্তর্জাতিক নৌবন্দর আশুগঞ্জের সাথেও নৌ যোগাযোগ যথেষ্ট নির্বিঘœ হবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম-বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ আরো উন্নত হবে। এমনকি দেশের ৩টি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আরো উন্নয়নে তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দরের নাব্যতা উন্নয়নসহ এ বন্দরের সুযোগ-সুবিধা আরো সম্প্রসারিত হবে বলেও আশা করছেন কর্তৃপক্ষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন