চাঁদপুরের বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বালু উত্তোলনের পক্ষে দেয়া হাইকোর্টের রায়ে ত্রুটি ছিলো-মর্মে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। গত ৮ মে প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এ মন্তব্য করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট রায়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, হাইকোর্টে এ বিষয়ে জারি করা রুলের বিরোধিতা করে কোনো এফিডেভিট দাখিল না করা এবং সেই সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তার ভূমিকা বেশ সন্দেহজনক। এছাড়া চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দীর্ঘ সময় এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন,চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের তৎকালীন কর্মকর্তারা বালু উত্তোলনে কার্যক্রমে কোনো তদারকি করেন নি।
এর আগে গত ২৯ মে সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলন করার অনুমতি দিয়ে হাই কোর্টের দেয়া রায় বাতিল করেন আপিল বিভাগ। গত ৮ আগস্ট ওয়েবসাইটে ১৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রায়ে ২১ মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে বালুউত্তোলনের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণ এবং ৪ বছরে প্রাপ্য রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন। চাঁদপুর জেলা প্রশাসনকে এ রায় কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
রায়ে হাইড্র্রোগ্রাফিক বিভাগের ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির চিঠি উল্লেখ করে বলা হয়,এতে প্রতীয়মান হয় যে,ওই মৌজাগুলোতে পর্যাপ্ত মাটি বা বালু রয়েছে এবং তা উত্তোলনে কোনো বাধা নেই। আপত্তি জানিয়ে বিবাদীদের (ভূমি সচিব, নৌপরিবহন সচিব,বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান,চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ বিভাগের পরিচালক)র পক্ষ থেকে কোনো জবাব দাখিল করা হয়নি। যাতে বালু থাকার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।হাইকোর্টের রায়ে ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে ৮৬ দশমিক ৩০ কিউবিক মিটার (৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘন ফুট) বালু সেলিম খানকে উত্তোলনের অনুমতি দিতে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্টের দেয়া এই রায়ের ৪ বছর পর চলতি বছর এপ্রিলে লিটু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৪ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এই চার বছর সেলিম খান নির্বিবাধে ডুবোচর কেটে বালু উত্তোলন করেন। এ সময় তিনি সরকারকে কোনো রাজস্ব দেননি।
রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিলে বলা হয়, বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে কোনো নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক জরিপই যে একক ভিত্তি নয়,তা হাইকোর্ট উপলব্ধি করতে পারেন নি। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে পরিবেশ,পাহাড় ধস,ভূমি ধস, অথবা নদী বা খালের পানির স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন,সরকারি স্থাপনা (ব্রিজ,কালভার্ট,রাস্তাÑঘাট,ফেরীঘাট,হাটবাজার,চা বাগান,নদীর বাঁধ ইত্যাদি) এবং আবাসিক এলাকার কোনো ক্ষতি হবে কি না সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামত গ্রহণ করবেন জেলা প্রশাসক।এছাড়া বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট বা সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত ও জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে ওই বালুমহার বিলুপ্তির প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন জেলা প্রশাসক। চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ডুবোচরের বালু উত্তোলনের বিষয়ে কোনো ধরণের মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি রিটে উল্লিখিত মৌজাগুলো বিভাগীয় কমিশনার বালুমহাল হিসেবে ঘোষণা দেননি।তাই হাইকোর্ট বিভাগ সেলিম খানকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটি বাতিলযোগ্য।হাইড্রোলিক জরিপের মাধ্যমে নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা এবং মানচিত্র তৈরি করা হয়। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোলিক জরিপ করতে হয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান বলেন, আপিল বিভাগ চাঁদপুরের ডিসিকে সেলিম খান থেকে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব নির্ধারণ করে টাকা আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ডিসি সাহেব আইনের আলোকে সেলিম খানের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নেবেন। চাঁদপুর সদর ও হাইমচরের ২১ মৌজা এলাকায় মেঘনা নদীতে ‘জনস্বার্থে’ নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনার নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করেন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ট লোক হিসেবে পরিচিত লক্ষ¥ীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম খান। রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্ট তাকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু গত ৪ এপ্রির রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিলের প্রেক্ষিতে চেম্বার জজ স্থগিত করেন হাইকোর্টের রায়। একইসঙ্গে বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ে ‘গুরুতর ত্রুটি’ ছিলো। এতে আরও বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে সরকারকে কোনো রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই বালু উত্তোলন করেন সেলিম খান। এতে সরকারের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত: চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যারয়ের জমি অধিগ্রহণে সরকার নির্ধারিত মৌজা মূল্যের চেয়ে অন্তত ২০ গুণ বেশি মূল্য দেখিয়ে ১৩৯টি উচ্চমূল্যের দলিল কারসাজির মাধ্যমে সরকারের প্রায় ৩শ’ থেকে ৪শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করেছিলেন শিক্ষা মন্ত্রীর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ ওরফে টিপু,চাঁদপুর মডেল ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ ঘনিষ্ট কয়েকজন। তারা ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ৪৮ একরের বেশি জমির দখল নেন। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ জমি কেনেন টিপু। পরে এই জমি অধিগ্রহণের আওতায় বহুগুণ বেশি দামে বিক্রির উদ্যোগ নেন। কিন্তু চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের এক চিঠির সূত্র ধরে বিষয়টি দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ধরা পড়ে। তাদের ষড়যন্ত্র যদি সফল হতো তাহলে সরকারের অতিরিক্ত ৩-৪ শত কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হতো। এই ঘটনা আলোতে আসার পর এক এক করে বেরিয়ে আসে মন্ত্রীর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের অপকীর্তি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন