এ দিনে সওম পালনের ফজিলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কে আশুরার সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেনঃ “ বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” (সহীহ মুসলিম ও তিরমিজি) অন্য বর্ণনায় এসেছে” আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আশুরার দিনের সওমকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।” (সহীহ মুসলিম) হাদীসে আরো এসেছে যে আশুরার সওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।” (মুসনাদুল বাযযার)
ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল- যে সওম পালনকারীর গুনাহ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার গুনাহ নেই আশুরার সওম তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী) মোট কথা আশুরার দিনের সওম হল এক বছরের সওমতুল্য। রাসূলে কারীম স. এ সওমকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনাতে আগমন করলেন তিনি ইহুদীদের সওম পালন করতে দেখলেন তখন তিনি সওম পালন করলেন অন্যদের সওম পালন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনকি যারা আশুরার দিনে আহার করেছিলেন তাদের দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। কেননা তিনি হিজরতের প্রথম বছর মুহাররম মাস শেষ হওয়ার একমাস পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে মদীনাতে আগমন করেছিলেন
“আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার সওম পালন করত এবং রাসূলুল্লাহও স. সওম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ সওম পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমজান মাসের সওম ফরজ হল তখন তিনি আশুরার সওম সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশুরার সওম পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
“মহিলা সাহাবী রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ স. আশুরার দিনে ভোরে মদীনার নিকটবর্তী আনসারদের মহল্লায় খবর পাঠালেন যে, তোমাদের মধ্যে যে সওম শুরু করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর যে সওম শুরু না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে সে যেন দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শোনার পর আমরা সওম পালন করলাম এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ছোট ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সওম পালন করালাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। বাজার থেকে খেলনা কিনে নিতাম। যখন খাবার চাইত তখন হাতে খেলনা তুলে দিতাম, যেন তারা খাবারের কথা ভুলে গিয়ে সওম পূর্ণ করতে পারে।” (সহীহ মুসলিম) উপরোক্ত হাদীস দুটি দ্বারা বুঝে আসে আশুরার সওম তখন ওয়াজিব ছিল।
তাই সর্ব-সম্মত কথা হল আশুরার সওম প্রথমে ফরজ ছিল, এখন তা ফরজ নয়, সুন্নাত।
ইবনে আব্দুল বারর রহ. বলেছেন, আশুরার সওম মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে উম্মাতের ইজমা (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই এটা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যেমন হাদীসে এসেছে- ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ স. কে এ সওম ছাড়া অন্য কোন সওমকে এত বেশি গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হল আশুরার সওম ও এই রমজান মাসের সওম।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
ইবনে আব্বাস রা. আরো বলেন, যারা বলে যে, আশুরার সওম তেমন গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব নয়, সাধারণ মুস্তাহাব। তাদের এ কথা ঠিক নয়। আসল কথা হল এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব আমল। তাইতো আমরা দেখতে পাই আল্লাহর রাসূল স. প্রত্যেক আশুরাতে সওম পালন করতেন। এমনকি ইন্তেকালের বছরও তিনি বলেছিলেনঃ ‘যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আগামী বছর মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে সওম পালন করব এবং এ সওম পালন দ্বারা এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়।’ (সহীহ মুসলিম)। এ সকল হাদীস দ্বারা আশুরার সওমের গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়।
আশুরার সওমের ব্যাপারে ইহুদীদের বিরোধীতা করার নির্দেশ : যে সকল বিষয়ে কোন শরয়ী হুকুম অবতীর্ণ হয়নি মদীনায় আসার পর সে সকল বিষয়ে নবী কারীম স. ইহুদীদের অনুরূপ আমল করা পছন্দ করতেন। যেমন তিনি মসজিদুল আকসাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীরা যেন ইসলামকে নিজেদের ধর্মের মতই মনে করে, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে যখন সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদীদের অবাধ্যতা, হিংসা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা,বর্ণবাদী নীতি ও চরম সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেল তখন সকল ব্যাপারে তাদের বিরোধীতা করার নির্দেশ দেয়া হল এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে তাদের সাথে সাদৃশ্যতাপূর্ণ সকল আমল ও আচরণ করতে নিষেধ করা হল।
তাই রাসূলুল্লাহ স. সংকল্প করলেন আশুরার দিনে তিনি ইহুদীদের মত আর একটি করে সওম পালন করবেন না। বরং এ সওমের সাথে মুহাররম মাসের নবম অথবা একাদশ তারিখে একটি সওম বাড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ইহুদীদের ধর্ম ও সাংস্কৃতির বিরোধীতা করবেন। এর প্রমাণ হিসেবে বহু হাদীস এসেছে। যেমন- ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ স. আশুরার সওম পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেনঃ “এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খৃষ্টানরা সম্মান করে থাকে।” তখন রাসূলুল্লাহ স. বললেন, আগামী বছর আসলে ইনশাআল্লাহ আমরা নবম তারিখে সওম পালন করব। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলে কারীম স. ইন্তেকাল করলেন। (সহীহ মুসলিম)
এ হাদীস থেকে এ কথা বুঝে নেয়ার অবকাশ নেই যে, রাসূলুল্লাহ স. আশুরার সওমটা মুহাররম মাসের দশ তারিখের পরিবর্তে নবম তারিখে পালনের সংকল্প করেছিলেন। বরং তিনি সংকল্প করেছিলেন নবম ও দশম দু দিন সওম পালন করার। কেননা আশুরা হল দশম তারিখ। সেদিন বাদ দিয়ে সওম পালন করলে তা আশুরার সওম বলে গণ্য হয় কিভাবে? হাদীসে এসেছে রাসুলুল্লাহ স. আশুরার সওম পালন করতে বলেছেন দশম তারিখে”
আশুরার সওম পালনের নিয়ম : ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন তোমরা আশুরা দিবসে সওম পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধীতা কর। তাই তোমরা আশুরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে সওম পালন করবে। (মুসনাদে আহমদ) আশুরার সওম পালন সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্র করলে আশুরার সওম পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসা যায় আর তাহলো : (১) রাসূলুল্লাহ স. আশুরার দিনে সওম পালন করতে বলেছেন। তাই আশুরার দিনকে বাদ দিয়ে সওম পালন করলে তা আশুরার সওম হবে না। (২) আশুরার সওম পালনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধীতা করতে হবে। তাই ইহুদীদের মত দশম তারিখে একটি মাত্র সওম পালন করা যাবে না। (৩) আশুরার একদিন পূর্বে সওম পালন করতে হবে। (৪) যদি আশুরার পূর্বের দিন সওম পালন করা কোন কারণে সম্ভব না হয় তাহলে আশুরা ও তার পরের দিন সওম পালন করতে হবে।
উপসংহার : মুহাররম মাস আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয় আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ স. এর হিজরত ও তার দাওয়াতী জিন্দেগী শুরু ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ মাসে রয়েছে এমন একটি দিন, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে দিনে নবী মুসা আ. এর বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরাউন ও তার সম্রাজ্যের। সে দিনটিই হল আশুরা; মুহাররম মাসের দশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদেরকে এই পবিত্র দিনে সকল প্রকার অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার ও বিদয়াত উপেক্ষা করে ইবাদত বন্দেগী করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করেন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন