ঠিক দুপুরের দিকে, কুয়াশায় ঝাপসা কিছু লক্ষ্য করা গেল দিগন্ত রেখায়। কিছু বুঝা যাচ্ছিল না-অস্প’। একটু পর দেখা গেল একদল অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে খুব দ্রুত। হজরত হুসাইন (রা.) তার সঙ্গীদের পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। এরই মাঝে দেখা গেল এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যদল হজরত হোসাইনের মুকাবেলায় তাদের বিপরীত দিকে শিবির গাড়ছে। এদিকে জোহরের সময় হয়ে গিয়েছে। হজরত হোসাইনের আহ্বানে প্রতিপও নামাজের জন্য একত্রিত হল। হোসাইন (রা.) তখন সবার উদ্দেশে একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণ শেষে দুই দল জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। প্রতিপরে সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ- তার অনুরোধে নামাজে ইমামতি করেছে হজরত হোসাইন (রা.)। নামাজ শেষে আরেকটি ভাষণ দিলেন। এ দুই ভাষণে হোসাইন (রা.) তার কুফা আগমনের উদ্দেশ্য সবাইকে জানিয়ে দিলেন। তার চিঠিপত্রের কথা বললেন। কিন্তু তারা অস্বীকার করল। তবে হুর ইবনে ইয়াজিদের অন্তর ছিল নবীর পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় ভরা। পাষণ্ড ইবনে জিয়াদ তাকে নির্দেশ দিয়েছিল হজরত হোসাইনকে যেভাবেই হোক পাকড়াও করে কুফায় তার সামনে নিয়ে যেতে, তিনি যেন মক্কায়ও ফেরত না যেতে পারেন। কিন্তু হোসাইন সাফ জানিয়ে দিলেন- ‘আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইবনে জিয়াদের সামনে যাব না।’ তখন হুর ইবনে ইয়াজিদ হোসাইনকে বললেন, ‘তাহলে আপনি মক্কা ও কুফার পথ ছেড়ে অন্য কোন পথে অগ্রসর হন, যাতে আপনার পথ পরিবর্তনের কথা বলে আমি আপনার সঙ্গে মোকাবেলা থেকে বাঁচতে পারি।’ তার কথা মতো হোসাইন (রা.) ‘আজিব’ এবং ‘কাদেসিয়া’র পথকে পাশে রেখে বাম দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি যখন ‘নাইনুবি’ নামক স্থানে পৌঁছলেন তখনই কুফা থেকে ইবনে জিয়াদের পরপর কয়েকটি বার্তা এলো তাতে লেখা ছিল-‘হোসাইনের চলার গতি সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হোক খোলা মরুভূমি, যেখানে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এমন স্থান ছাড়া হোসাইন অন্য কোথাও যেন শিবির গাড়তে না পারে। আর ফোরাতের পানি থেকে তারা যেন পুরোপুরি বঞ্চিত থাকে।’ ওদিকে হজরত হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আরও চার হাজার সৈন্য পাঠানো হল। তাদের সেনাপতি ছিলেন ওমর ইবনে সা’দ। তিনিও নবী-পরিবারকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তারা আজ অসহায়। মহররমের ৭ তারিখ। ইবনে জিয়াদের নির্দেশ মতো হোসাইনের (রা.) কাফেলার জন্য পানি বন্ধ করে দেয়া হল! কাফেলার জমানো পানি শেষ! পানির তৃ‘ায় তপ্ত মরুভূমির মাঝে ছটফট করছে নারী ও কচি শিশুরা! হজরত হোসাইন (রা.) অসহায়! ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে তিনটি প্রস্তাব পেশ করলেন- ‘১. আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক। ২. অথবা আমাকে সরাসরি ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হোক। ৩. কিংবা আমাকে অন্য কোন মুসলিম দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক।’ নিষ্ঠুর ইবনে জিয়াদ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। হজরত হোসাইন (রা.) ভীষণ আঘাত পেলেন। মহররমের নয় তারিখ। হজরত হোসাইন (রা.) স্বপ্নে দেখলেন, তার নানাজান হুজুর (সা.) তাকে বলছেন- ‘হে হোসাইন! তুমি তো অল্প কিছুণের মধ্যেই আমার কাছে চলে আসছ।’ এ কথা জয়নাবকে জানালে তিনি তো হাউমাউ করে কেঁদেই দিলেন। সেদিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা মুলতবি করা হয়েছে। মহররমের দশ তারিখ। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। দুই কাফেলা সৈন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো।
এ সময় হোসাইন (রা.) প্রাঞ্জল ভাষায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বললেন- ‘আমার মর্যাদাহানি তোমাদের জন্য সুখ বয়ে আনবে এমন ভেবে থাকলে তোমরা মারাত্মক ভুলের মাঝে আছ। নানাজান তো বলেছেন, জান্নাতের যুবকদের নেতা হবে হাসান ও হুসাইন।’ তিনি তার আগের ভাষণগুলোতে বার বার মক্কায় ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোন কথাই কর্ণপাত করেনি নিষ্ঠুর পাষণ্ডগুলো। এরপর হুর ইবনে ইয়াজিদ কুফাবাসীর উদ্দেশে হোসাইনের (রা.) পক্ষ হয়ে একটি ভাষণ দিলেন। তিনি এখন ‘হোসাইনি কাফেলার দলে। ইবনে জিয়াদের পা-চাটা গোলাম শিমারের সহ্য হল না। সৈন্যদের আদেশ দিল তীর নিক্ষেপের। যুদ্ধ শুরু হল। তীরের আঘাতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে মানুষ, মানবতা, ইসলামী খেলাফত! মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল অসংখ্য শত্রু বাহিনী। হোসাইনের (রা.) অনেক সঙ্গীও শাহাদাত বরণ করলেন। শত্রুরা আলী ইবনে হোসাইনের (রা.) লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। হজরত হোসাইন (রা.) বলেই ফেললেন, ‘হে আলাহ! যারা এ নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করেছে তুমি ওদের বিচার করো, নির্মূল করে দাও ওদের বংশ।’ ওদিকে বেহায়া আমর ইবনে সা’দ তরবারি দিয়ে আঘাত করল হজরত হাসানের (রা.) ছেলে কাসেমের মাথায়। গুরুতর আহত অবস্থআয় কাসেম চিৎকার দিলেন- ‘চাচাজান!’ হোসাইন (রা.) দৌড়ে গিয়ে আমরকে আঘাত করলেন। আমরের ডান হাত ঝরে পড়ে গেল। কাসেম আর নেই! হজরত হোসাইন (রা.) কাসেমের লাশকেও কাঁধে নিয়ে ছেলে আলীর পাশে শুইয়ে দিলেন।
কেউ নেই, আল্লাহ ছাড়া তার আর কেউ নেই! ক্লান্ত ক্ষুধার্ত, পিপাসায় কাতর, একা এক মুসাফির। হিংস্র হায়েনার দলগুলো একে একে সবাইকে শেষ করে দিল। কোলে ছিল শিশু আবদুলাহ যাকে আদরে সোহাগে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বনি আসাদের নিষ্ঠুুর এক পশু আবদুলাহকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়লে সেই আঘাতে আবদুলাহ মারা যান। হোসাইন একা। প্রচন্ড পিপাসায় ফোরাতের দিকে ছুটছেন। শিমার বাহিনীর সঙ্গে লড়ছেন বীরদর্পে। কেউ কাছে আসতে সাহস করছে না! আতংকে এদিক-ওদিক দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে! এখানেই ইতিহাসের বিস্ময়! চির-বিস্ময়! নিকৃ’ ‘হাসীন ইবনে নুমাইর’- তীর ছুড়ল হোসাইনকে লক্ষ্য করে। প্রিয় হোসাইনের কণ্ঠদেশে বিদ্ধ হল। শুরু হল রক্তক্ষরণ। হারামি শিমার এ সুযোগটাকে কাজে লাগাল। হায়েনার দলগুলো একযোগে হোসাইনের ওপর আক্রমণ করল। ক্লান্ত-শ্রান্ত হোসাইন, এখন একেবারেই নিথর। শাহাদাতের সুধা পান করে চলে গেলেন নানাজানের দেশে! কিন্তু ফোরাতের পানি আর পান করা হল না তার! হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি কিবা খ্রিস্টান, সবার কপালে এ ফোরাতের পানি জোটে, চারণভূমির পশুগুলোও এখান থেকে খায়, কিন্তু মুসলিম মিলাতের হৃৎপিন্ড ইমাম হোসাইনকে কেন এ পানি দেয়া হল না? সেই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস আজও দিতে পারেনি-! সেদিন মানবতার ছিটা-ফোটাও কি এ দুনিয়ায় ছিল না- যে একজন ইমাম, একজন শহীদের মৃত দেহ থেকে মাথা কেটে নিতে কেউ বাধা দিল না?
তার পবিত্র দেহকে ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষে ফেলতে কারও হৃদয়ে কিঞ্চিৎ দয়ার উদ্রেক হল না? ধিক্কার- এ মানবতাকে! ছি!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন