সব ধরণের পণ্যে বাজার ঠাসা। তারপরও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন পাগলা ঘোড়ার মতো পণ্যমূল্য বেড়েই যাচ্ছে। বাজার দেখভালের দায়িত্ব যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তারা বাজারে নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সচিবালয়ে মাঝেমধ্যে বৈঠক করার খবর প্রচার হচ্ছে। অতঃপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সহজ সরল স্বীকারোক্তি ‘ব্যসায়ীরা সুবিধা নিচ্ছেন’ ‘ব্যবসায়ীরা কথা রাখছেন না’ ‘এমন হবে বুঝতে পারিনি’ ‘এক মাস পর দাম সমন্বয় করা হবে’ ইত্যাদি উক্তি করে তিনি যেন ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রীর এই ‘খেই’ হারানো কথাবার্তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো, শুল্ক প্রত্যাহার এবং কোটি পরিবারকে টিসিবির ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রির কর্মসূচি নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। এতে করে বাজার করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের পরিবারগুলো।
‘বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি অনুভব করেনি’ গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজারে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ প্রচুর। তরিতরকারি থেকে শুরু করে ডাল-ডাল-তেল-মাছ সব পণ্যেই দোকান ঠাঁসা। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। অথচ প্রতিটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ঊর্ধ্বমুখে ছুটছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে ফার্মের মুরগির ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দামে কিছুটা কমলেও বাড়ছে তেল, চিনি ও চালের দাম। ফলে বিপাকে পড়ে গেছেন নিম্নআয় ও মধ্যবিত্ত মানুষরা। মানুষের জীবন যেন চলে না। নিত্যপণ্য মূল্য থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সাধারণ মানুষের ব্যয় বেড়েছে। ঘর থেকে বের হলেই খরচ। রিকশা, সিএনজি, বাস, লঞ্চ সবকিছুই ভাড়া বেড়েছে। ওষুধ, জামা-কাপড়, শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় ব্যয় বেড়ে গেছে।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষক পরিষদের পরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, পণ্যমূল্যের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঠেকাতে অভিযান চলছে। তবে অভিযান চালিয়ে এটা বন্ধ করা যাবে না। কারণ অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীরা যদি নীতি-নৈতিকতার বিসর্জন দেয়, তাহলে দাম কমবে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতিলোভী একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পরিবহন খরচ বেশি অজুহাতে পণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছে। যে পণ্যের পরিবহন খরচ কেজিতে ৪০ পয়সা বেড়েছে, সেই পণ্যের মূল্য কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সিপিডিসহ কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে জানিয়েছেন পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। যারা তিন বেলা খেতেন, তারা এখন দুই বেলা খাবার খান। মাছ, গোশত, দুধ, ডিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন লাখ লাখ গৃহস্থ পরিবার। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানানো হয় ৫ শতাংশ ভোক্তা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। অনেক ভোক্তা পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যপণ্য বিশেষ করে গম ও ভোজ্যতেল, সার ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এ ছাড়া দাম বেড়েছে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যেরও। এতে বলা হয়, দেশের মানুষ এখন খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেলের পেছনে সাড়ে ১৪ শতাংশ, অন্যান্য খাদ্যের পেছনে ৪৩ শতাংশ এবং খাদ্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য কেনাকাটা ও সেবার পেছনে সাড়ে ৪২ শতাংশ অর্থ খরচ করছে। খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংকট উত্তরণে সরকারও উন্নয়ন সহযোগীদের নীতিনির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়Ñ গম, আটা, তেলবীজের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়া, ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমানো, সারের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, দক্ষতার সঙ্গে সার ব্যবহার, সারের পরিবহন খরচ কমানো, সারের উৎপাদন বাড়ানো, দরিদ্রদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়ে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, এক সাপ্তাহে চাল, ডাল, তেল ও পেঁয়াজসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখে ভোক্তারা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। জ্বালানি তেল কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের মূল্যবৃদ্ধির পর কয়েক দফায় বাড়ে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। ফলে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা হয়ে যায়। আর ডিমের ডজন ওঠে ১৬০ টাকায়। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও এত বেশি দামে ডিম বিক্রি হয়নি। তবে গতকাল বাজারে দেখা যায় ডিমের দাম হালিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমেছে। শুক্রবার লাল ও সাদা রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি হালি ৫০ টাকার কমে। ভোক্তারা বলছেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘ডিম আমদানির করা হবে’ বক্তব্যের পরের দিনেই ডিমের দাম কমেছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কাপ্তানবাজার, ফকিরেরপুল বাজার ও শনির আখড়া বাজার ঘুরে দেখা যায়Ñ এক ডজন ফার্মের ডিম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মুদি দোকানে প্রতিটি ডিম ১১ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েক দিন আগে মুদি দোকানে প্রতিটি ডিম ১৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আর হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হয় ২১৫ থেকে ২২৫ টাকায়। দেশি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২৩৫ থেকে ২৪৫ টাকায়।
জানা গেছে, মাছ ও গোশতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটায় ডিম। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ডিমের তরকারি বেশি খাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা ডিম কেনা একেবারে কমিয়ে দেন। এ ছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাদের চাহিদাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে চাহিদা না থাকায় পাড়া-মহল্লার দোকানিরাও দোকানে কম ডিম তুলছেন।
রাজধানীতে বসবাসকারী পেশাজীবীদের মধ্যে শুক্রবার সাপ্তাহিক বাজার করার রেওয়াজ বহুদিনের। গতকাল ছিল সেই শুক্রবার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, গত সপ্তাহে প্রতিকেজি ২০০ টাকা করে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম কমে গতকাল ১৮০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগির দামও কমেছে। গত সপ্তাহে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকার সোনালি মুরগি এখন কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। ডিমের মতোই দাম কমলেও ব্রয়লার মুরগি যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাকে স্বাভাবিক বলছেন না ক্রেতারা। শনিরআখড়া বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা ইলিয়াস হোসেন বলেন, ব্রয়লার মুরগির কেজি আগের চেয়ে কমলেও এখনও ১৮০ টাকা চাচ্ছে। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে তেমন কিছুই কেনা যায় না।
বাজারে দেখা গেল, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ফের বেড়েছে। খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায়। নাজির ও মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। গরিবের মোটা চাল এখন ৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মাঝারি মানের চালের দাম ৫৮ টাকা কেজি। প্যাকেট আটা ৬৫ টাকা এবং চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি দরে। বাজারে রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছেÑ ৩২০ থেকে ৪৫০ টাকা। তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছের কেজি ২০০ টাকা। শিং মাছের কেজি ৩৫০ থেকে ৪৬০ টাকা, কৈ মাছের কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, পাবদা মাছের কেজি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। আর ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছেÑ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
সবজির বাজারেও গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। আর শিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি। ১০০ টাকা বেশি দামের সবজির তালিকায় রয়েছে টমেটো ও গাজর। সবজি দুটি বিক্রি হচ্ছেÑ ১৩০ টাকা ও ১৬০ টাকা করে। কাঁচামরিচ ২০০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, কাঁকরোল ৪০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৪০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, শসা হাইব্রিড ৮০ টাকা, আর দেশি ৯০ টাকা, বড় কুমড়া ৫০ টাকা, জালি কুমড়া প্রতিটি ৪০ টাকা, কাঁচা কলা হালি ২৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি পিস ৩০ টাকা, ধুন্দল কেজি ৪০ টাকা, কচুরমুখী ৪০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, পটল ৪০ টাকা, আলু ৩০ টাকা, রসুন ৮০ থেকে ১২০ টাকা, আদা ১০০ থেকে ১২০ টাকা, পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, কচুর লতি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁইশাকের আঁটি ২০ টাকা, লালশাক ১৫ টাকা, মুলাশাক ১৫ টাকা, কলমিশাক ১০ টাকা, ডাটাশাক ১০ টাকা, পালংশাক ৩০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন